দক্ষিণ ফ্রান্সে সংক্ষিপ্ত গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটিয়ে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যখন প্যারিসে ফিরলেন, তখন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক ভয়াবহ রাজনৈতিক ঝড়। আগামী সোমবারই হয়তো তিনি হারাতে যাচ্ছেন ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীকে। ফ্রাঁসোয়া বাইরু আস্থাভোটে টিকতে পারবেন না—এটা নিয়ে কারও মনে আর সন্দেহ নেই।
প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার ক্রমেই “ফিউজ” হয়ে যাচ্ছিল, একে একে জ্বলে উড়ে যাচ্ছে। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে—ম্যাক্রোঁ নিজে আর কতদিন টিকে থাকতে পারবেন?
ম্যাক্রোঁর রাজনৈতিক অস্থিরতার মূল শুরু গত বছর। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ম্যারিন লো পেনের ন্যাশনাল র্যালির কাছে হেরে গিয়ে তিনি হঠাৎ করেই জাতীয় নির্বাচন ডাকেন। ফলাফল দাঁড়ায় এক অচল সংসদ—কোনও পক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, সরকার হয়ে যায় সংখ্যালঘু। ফলে রাষ্ট্রপতি হয়ে পড়েন কার্যত “লেম ডাক”—দুই চরমপন্থী ডান ও বামের হাতে জিম্মি হয়ে। সামনে এখনও দুই বছর বাকি তাঁর দ্বিতীয় ও শেষ পাঁচ বছরের মেয়াদের। কিন্তু ইতিমধ্যেই আকাশে কালো মেঘ জমে উঠেছে।
অর্থনৈতিক টানাপোড়েন
রাজনৈতিক অচলাবস্থার পাশাপাশি অর্থনীতি নামছে নিম্নগামী পথে। ফ্রান্সের বাজেট ঘাটতি ইউরোজোনে সবচেয়ে বেশি—চলতি বছর জিডিপির ৫.৪ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা। জাতীয় ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩.৩ ট্রিলিয়ন ইউরো, যা জিডিপির ১১৪ শতাংশ। বাজারে সুদের হার বাড়ছে, ঋণ ব্যবধান বিস্তৃত হচ্ছে। ১৫ অক্টোবরের মধ্যে কঠোর ব্যয়সঙ্কোচন বাজেট পাস না হলে ফ্রান্স আইএমএফের হস্তক্ষেপের মুখোমুখি হতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাইরু ঘোষণা করলেন ৪৪ বিলিয়ন ইউরো খরচ কমানোর পরিকল্পনা। এর মধ্যে আছে দুটি জাতীয় ছুটি বাতিল এবং পেনশনভোগীদের জন্য বাড়তি কর। তিনি সতর্ক করে বলেন—যদি পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, তবে ফ্রান্সও ব্রিটেনের লিজ ট্রাস আমলের মতো ভয়াবহ সংকটে পড়বে।
রাস্তায় ক্ষোভ: নতুন আন্দোলনের ডাক
এদিকে রাস্তায় নামছে জনগণ। “ব্লোকোঁ তু” বা “সব বন্ধ করো” নামের এক আন্দোলন ১০ সেপ্টেম্বর থেকে দেশ অচল করে দেওয়ার ডাক দিয়েছে। পুলিশের গোপন নোটে সতর্ক করা হয়েছে, রেলস্টেশন অবরোধ, তেলশোধনাগার অবরোধ, এমনকি সুপারমার্কেট থেকে টাকা না দিয়েই পণ্য নেওয়ার মতো কর্মসূচি হতে পারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে সহিংসতা ও নাশকতার।

১৮ সেপ্টেম্বর আবার ইউনিয়নগুলো ডাক দিয়েছে বৃহৎ বিক্ষোভের। এতে স্পষ্ট—সরকারি পতনের সম্ভাবনা আন্দোলনকারীদের আরও উদ্দীপ্ত করছে।
আস্থাভোট ঘিরে বাইরুর ভাগ্য আগেই সিল হয়ে গিয়েছিল। ম্যারিন লো পেনের ন্যাশনাল র্যালি এবং জঁ-লুক মেলঁশোর ফ্রান্স আনবাউড আগেই জানিয়ে দেয় তারা সমর্থন করবে না। শেষ মুহূর্তে সোশ্যালিস্ট পার্টিও ঘোষণা দেয়, তারা আস্থা দেবে না। তাদের নেতা অলিভিয়ের ফোর সাফ জানিয়ে দেন—“এখন শুধু বিদায়ের শব্দটিই শুনতে চাই।” ফলে বাইরুর রাজনৈতিক আত্মঘাতী বাজি শেষ পর্যন্ত তাঁকেই গিলে ফেলছে।
সামনে কোন পথ?
ম্যাক্রোঁর সামনে এখন তিনটি সম্ভাবনা—
- বাইরুর পরিবর্তে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ, যিনি সংসদে টিকে থাকতে পারবেন।
- সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচন ডাকতে হবে।
- অথবা চরম বিকল্প: নিজেই আগেভাগে পদত্যাগ করে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডাক দেওয়া।
তবে নতুন নির্বাচনের পথে হাঁটতে ম্যাক্রোঁ অনিচ্ছুক। কারণ গতবারের তড়িঘড়ি নির্বাচনে তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান রাস্তাঘাটের আন্দোলন হয়তো তাঁকে সেদিকেই ঠেলে দেবে।
সর্বশেষ জরিপ বলছে, ফরাসি নাগরিকদের ৬৭ শতাংশ চান ম্যাক্রোঁ পদত্যাগ করুন। বিরোধীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে—জনগণ আর তাঁকে চায় না। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠরা বলছেন, ম্যাক্রোঁ যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালানোর মানুষ নন। তিনি সব রকম সমাধান খুঁজবেন, কিন্তু মাঠ ছাড়বেন না।
ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে
অর্থনীতি বিপদে, রাজনীতি অচল, রাস্তায় আন্দোলন দানা বাঁধছে। সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘুরে বেড়ালেও অনেকের ধারণা—যে-ই আসুক, স্থায়ী হবে না। আরেকটি আগাম নির্বাচন ডাকার সম্ভাবনাই প্রবল হয়ে উঠছে। এমনকি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজিও বলছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন নির্বাচন অনিবার্য।
কিন্তু তাতেও স্থিতিশীলতা আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ ফ্রান্সের রাজনীতিতে এখন যে গভীর বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা সহজে মেরামত হওয়ার নয়। দেশজুড়ে শোনা যাচ্ছে একটাই প্রশ্ন—ম্যাক্রোঁ কি সত্যিই ফ্রান্সকে অচল করে ফেলেছেন?