প্যারিসে আবারও রাজনৈতিক ঝড়। ফরাসি সংসদে আস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরুর সরকার সোমবার বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে নতুন এক সঙ্কট শুরু হলো, যেখানে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে টানা চতুর্থবারের মতো নতুন প্রধানমন্ত্রী খুঁজতে হচ্ছে।
আস্থা ভোটে সরকারের পতন
বাইরু ১৯৪–এর বিপরীতে ৩৬৪ ভোটে হেরে যান। গত বছরের ডিসেম্বরে দায়িত্ব নেওয়া ৭৪ বছর বয়সী এই প্রবীণ রাজনীতিক বাজেট ঘাটতি কমাতে কৃচ্ছ্রসাধনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন সংসদ সদস্যরা দেশের ঋণ সংকট সমাধানের জন্য তাঁর পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু উল্টো, বাম ও ডানপন্থী বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
প্রায় নয় মাসের স্বল্পমেয়াদি সরকার গঠনের পর বাইরু এখন সাংবিধানিকভাবে পদত্যাগে বাধ্য। এ ঘটনায় ফ্রান্সে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাজেট ঘাটতি, বৈদেশিক ঋণের চাপ, পাশাপাশি ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতেও দেশটিকে এখন অচলাবস্থার ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
এক বছরের মধ্যে চতুর্থ সংকট
বাইরুর পতনের আগে গত এক বছরে ফ্রান্সের আরও দুই প্রধানমন্ত্রী সংসদে পরাজিত হয়ে বিদায় নিয়েছেন—গ্যাব্রিয়েল আতাল ও মিশেল বার্নিয়ে। এবার বাইরু বিদায় নেওয়ায় ম্যাক্রোঁকে আবারও এমন একজনকে খুঁজতে হচ্ছে যিনি ভাঙা সংসদের ভেতর দিয়ে টিকে থাকতে পারবেন। এলিসি প্যালেস জানিয়েছে, মঙ্গলবার বাইরুর পদত্যাগ গ্রহণ করবেন প্রেসিডেন্ট এবং কয়েক দিনের মধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হবে।
এই অচলাবস্থার মূল শেকড় ২০২৪ সালের জুনে। তখন ম্যাক্রোঁ জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন তাঁর মধ্যপন্থী জোট আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। সংসদ খণ্ডিত হয়ে যায়, কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এর ফলে সরকার গঠনের পর থেকেই টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাইরুর জুয়া
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেষ ভাষণে বাইরু নিজেই স্বীকার করেন, আস্থা ভোট ডাকা ছিল একপ্রকার জুয়া। তিনি বলেন, ফ্রান্সের ঋণ সঙ্কট “একটি নীরব, অদৃশ্য কিন্তু অসহনীয় রক্তক্ষরণ”। তাই বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা ছাড়া তাঁর কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
“যুদ্ধাস্ত্রে পরাধীনতা আর ঋণে পরাধীনতা—দুটোই সমান বিপজ্জনক,” সংসদে বলেন বাইরু। “যদি আমাদের ঋণই আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, তবে সেটি অস্ত্রের দাসত্বের মতোই ভয়াবহ।”
সরকারি হিসাবে, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ফ্রান্সের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩.৩৪৬ ট্রিলিয়ন ইউরোতে, যা দেশের জিডিপির ১১৪ শতাংশ। শুধু সুদ পরিশোধেই রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রায় ৭ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে।
লে পেনের দাবি: নতুন নির্বাচন
এই নাটকীয় অধিবেশনে সংসদ সদস্যরা গ্রীষ্মকালীন ছুটি ভেঙে ফিরেছিলেন। বিরোধীরা সুযোগ নিয়ে চাপ বাড়াতে শুরু করেছে—কেউ নতুন নির্বাচন চাইছে, কেউ সরাসরি ম্যাক্রোঁর পদত্যাগের দাবি তুলছে।
ফ্রান্সের দূর-ডানপন্থী নেতা মেরিন লে পেন বলেন, “এত বড় দেশ কাগুজে সরকার দিয়ে চলতে পারে না, বিশেষ করে এমন অনিশ্চিত সময়ে।” তিনি জাতীয় পরিষদ আবার ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের দাবি তুলেছেন।
সামনে কী?
প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ এখনো ২০২৭ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সংসদে সমর্থনহীনতার কারণে তাঁর অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী যেই হোন না কেন, তাঁকে একই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে—অতিরিক্ত বাজেট ঘাটতি, বৈদেশিক ঋণ এবং অচলাবস্থার সংসদ।
বাইরু বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন, “আপনারা সরকারকে পতন ঘটাতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা মুছে ফেলতে পারবেন না। ঋণ আরও বাড়বে, ব্যয়ও বেড়েই চলবে।”
ফ্রান্সের রাজনীতি এখন এক অনিশ্চিত মোড়ে দাঁড়িয়ে। আগামী দিনগুলোতে দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর পরবর্তী সিদ্ধান্ত ও নতুন প্রধানমন্ত্রী কতটা কার্যকরভাবে অচল সংসদে সমঝোতা গড়ে তুলতে পারেন তার ওপর।