বিশ্ব রাজনীতির আজকের কটাক্ষে আমেরিকার ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে একটি স্পষ্ট ছবি উঠে: কৌশলগতভাবে “দক্ষিণ এশিয়া ও ইসলামি বিশ্বের দেশগুলোকে বিভক্ত করে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা” এবং “রাশিয়া-চীনকে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখা।”
আমেরিকার এশিয়া ও ইন্দো-এশিয়ায় বিনিয়োগ: এক শতাব্দীর সংক্ষিপ্ত চিত্র
১৯২০-১৯৪০ সালে সীমিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, প্রধানত ফিলিপাইন ও চীনে। ইন্দো-এশিয়ায় ব্রিটিশ ও ডাচ উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের কারণে সীমাবদ্ধ কার্যক্রম।
১৯৫০-১৯৭০ সালে শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান এবং ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দো-এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়নে আমেরিকার ভূমিকা বৃদ্ধি।
১৯৮০-২০০০ সালে চীনের “ওপেন ডোর” নীতি অনুসরণে ব্যাপক বিনিয়োগ বৃদ্ধি। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মলয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ। ইন্দো-এশিয়ার উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে মার্কিন বহুজাতিক কর্পোরেশনের প্রবেশ।
২০০০-বর্তমান’ ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে প্রযুক্তি, ই-কমার্স ও পরিষেবা খাতে বিশাল বিনিয়োগ। গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের পুনঃসংগঠন ও প্রযুক্তি নিরাপত্তায় বিশেষ মনোযোগ। কৌশলগত ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে এশিয়া-ইন্দো-এশিয়ায় বিনিয়োগ বাড়ানো।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে আমেরিকার ‘খেলা’
আমেরিকা বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি দেশের ওপর নজর দিয়েছে— “বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারতের কিছুকিছু রাজ্য”। এই দেশগুলোকে ব্যবহার করে তার মূল লক্ষ্য:
“ভারতকে ভাঙ্গা, বিভক্ত করা,” যাতে ভারতের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
“রাশিয়া ও চীনের বাণিজ্যিক জোট ভাঙার চেষ্টা,” দক্ষিণ এশিয়া হয়ে ওঠে তাদের মোকাবিলায় স্ট্রাটেজিক ফ্রন্ট।
গত শতাব্দীতে আমেরিকার এই কৌশলে “ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ” ও প্রযুক্তিগত সহায়তা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপক হস্তক্ষেপ।
বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব
বঙ্গোপসাগর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলসীমা, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য ও সামরিক কৌশলের হৃদয়স্থল। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এই সাগরের উত্তরে, যা একে করে তুলেছে “বিশ্বশক্তিগুলোর জন্য অপরিহার্য একটি স্ট্রাটেজিক গেটওয়ে।” বঙ্গোপসাগর দিয়ে পারাপার হয় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিপুল পরিমাণ পণ্য ও জ্বালানি সামগ্রী। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক রুটের একটি চাবিকাঠি, যা ভারত ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সংযুক্ত করে। সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা—এসব কারণে এই অঞ্চলটি শক্তিশালী বিশ্বশক্তির জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন সবাই এখানে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে তৎপর, যা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে জটিল করে তুলছে।
ইসলামি বিশ্বের সংঘাতের নেপথ্যে আমেরিকার গোপন হাত
ইসলামী বিশ্বের কোথাও কোথাও সংঘাতের পেছনে আমেরিকার সরাসরি ও পরোক্ষ দখল স্পষ্ট। বিশেষ করে:
লিবিয়া (২০১১): গাদ্দাফির পতনের মাধ্যমে লিবিয়া দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কবলে পড়েছে। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর বিমান হামলা এই অস্থিতিশীলতার শুরু।
ইরাক (২০০৩): আমেরিকার আগ্রাসনের ফলে দেশটি দীর্ঘকালের যুদ্ধ ও সংঘাতে নিমজ্জিত।
সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান: বিভিন্ন সামরিক ও গোপনীয় হস্তক্ষেপে এসব দেশ আজ অস্থিরতার নীড়।
সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইন সম্পর্কে আলোচনা আপাতত বাদ দিলাম।
এই সংঘাতগুলোতে আমেরিকা আধুনিক “ড্রোন, সাইবার যুদ্ধ, গোয়েন্দা ও সামরিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার” করেছে।
প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক কৌশলে আমেরিকার আধিপত্য
সামরিক প্রযুক্তি: বিশ্বে সর্বাধুনিক ড্রোন ও রোবোটিক অস্ত্র সরবরাহে আমেরিকা শীর্ষে।
গোপন গোয়েন্দা ও সাইবার যুদ্ধ: সিআইএ ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (NSA) কৌশলগত কর্মকাণ্ড বিশ্ব রাজনীতির এক অপরিহার্য অংশ।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্য যুদ্ধ: প্রতিদ্বন্দ্বীদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগানো।
আরব বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ ও আমেরিকার আধিপত্য
আরব বিশ্বের মূল দেশগুলোতে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব অবিচ্ছেদ্য। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ইত্যাদি দেশের সঙ্গে মিত্রতা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদ ও রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করছে আমেরিকা।
আমেরিকার এই কৌশল— দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশগুলোকে ঘিরে ভারতকে দুর্বল করা, ইসলামি বিশ্বের অস্থিরতা সৃষ্টি করা এবং বিশ্ববাজারে রাশিয়া ও চীনের প্রভাব কমানো— হল আধুনিক বিশ্বযুদ্ধের অদৃশ্য মোড়ল।
এবার ভাবুন, এই ভূরাজনৈতিক খেলায় আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? কিভাবে আমাদের ছোট ছোট দেশগুলোও এই বৃহৎ কৌশলের অঙ্গ হয়ে উঠেছে?