বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার মুখোমুখি মানুষের সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরে কিছুটা কমেছে। ২০২৩ সালে ক্ষুধার সম্মুখীন মানুষ ছিল ৬৮৮ মিলিয়ন, যা ২০২৪ সালে কমে ৬৭৩ মিলিয়নে নেমেছে। এটি একটি ইতিবাচক সূচক, যা বোঝায় যে কিছু অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা উন্নতি করছে। তবে এই উন্নতি সমানভাবে ছড়িয়ে নেই এবং বৈশ্বিক ক্ষেত্রে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
আফ্রিকা একমাত্র মহাদেশ যেখানে ক্ষুধার প্রবণতা উল্টো যাচ্ছে। সেখানে ২০২৩ সালে ২৯৬ মিলিয়ন মানুষ পর্যাপ্ত পুষ্টি পাননি, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ৩০৬ মিলিয়নে পৌঁছেছে। এটি একটি উদ্বেগজনক বিষয়, কারণ আফ্রিকায় জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অপ্রতুল খাদ্য সরবরাহ এই পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে।
রিপোর্টটি সতর্ক করছে, এই ধারা যদি থেমে না যায়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ৫১২ মিলিয়ন মানুষ এখনও পর্যাপ্ত পুষ্টি পাবে না। এর মধ্যে প্রায় ৬০% মানুষ আফ্রিকায় অবস্থান করবে। অর্থাৎ, আফ্রিকা হবে বৈশ্বিক পুষ্টি সঙ্কটের মূল কেন্দ্র।
অফিসিয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী, আফ্রিকায় খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নত করার সম্ভাবনা এখনও আছে। মূল চ্যালেঞ্জ হলো কৃষি উৎপাদন বাড়ানো। কৃষি উন্নয়নে তিনটি মূল বিষয় গুরুত্বপূর্ণ:
১. মাটির উর্বরতা পুনরুদ্ধার: দীর্ঘদিনের খেতি, অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার এবং খরার কারণে আফ্রিকার মাটি পুষ্টিহীন হয়ে গেছে। মাটি পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে ফসলের ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
২. নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন গ্রহণ: আধুনিক বীজ, বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ, সেচ ব্যবস্থা এবং ফসল সংরক্ষণ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়।
৩. মানবসম্পদে বিনিয়োগ: কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে তারা আধুনিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতি গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ক্ষুধা কমার কারণ হিসেবে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি, সরকারি নীতি সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আফ্রিকাও যদি একই পথ অনুসরণ করে, তবে অপুর্ণ পুষ্টি ও ক্ষুধা কমানো সম্ভব।
তবে সময়সীমা সংকীর্ণ। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আফ্রিকার বৃহৎ জনসংখ্যা খাদ্য সঙ্কটে ভুগতে থাকবে। খাদ্য নিরাপত্তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক স্থিতিশীলতারও একটি মূল চাবিকাঠি।
আফ্রিকা মহাদেশ আজ এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। খরা, বন্যা এবং ক্ষয়প্রাপ্ত জমির কারণে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে আফ্রিকার নীতি নির্ধারকরা সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এই পরিস্থিতি রোধ করা সম্ভব। সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা এবং আবহাওয়ার চরম প্রভাব—যেমন খরা ও অতিবৃষ্টির ঝুঁকি কমানো।
এতে সফল হতে হলে সরকারকে আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং কৃষি খাতের প্রধান স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, এনজিও, ব্যাংক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান। একসাথে কাজ করলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আফ্রিকার কৃষি উন্নয়নের জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের দিকে জোর দিতে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হলো মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমি পুনরুদ্ধার। আফ্রিকার ৬৫% চাষযোগ্য জমি ক্ষয়প্রাপ্ত, যা প্রতি বছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সমান মাটির পুষ্টি হারিয়ে ফেলে। ধারাবাহিক চাষ এবং উপযুক্ত পরিচর্যার অভাব ফসল উৎপাদন কমিয়ে দেয়। মাটির উর্বরতা পুনরুদ্ধার করা না গেলে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো প্রায় অসম্ভব।
আফ্রিকার নেতারা ক্রমশ এই সংকটের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছেন। ২০২৪ সালে আফ্রিকান ইউনিয়ন সার্বিকভাবে সার ও মাটির স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করে। এতে কৃষি খাতের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার অংশগ্রহণ করেন এবং আফ্রিকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নের কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। এতে প্রতিটি কৃষি খাতে মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং বহু-পক্ষীয় অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধুমাত্র উৎপাদন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমি পুনরুদ্ধার এবং স্থায়ী কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগ করা আবশ্যক। যদি আফ্রিকার সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা একসাথে কাজ করতে পারে, তবে মহাদেশটি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে এবং খরা-বন্যার মতো প্রাকৃতিক ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে। এটি শুধু কৃষকদের নয়, পুরো মহাদেশের জনগোষ্ঠীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আফ্রিকার কৃষিক্ষেত্রে টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বিনিয়োগ বৃদ্ধি একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। বর্তমানে অধিকাংশ আফ্রিকান দেশ তাদের কৃষিখাতের মোট জিডিপির মাত্র ১%-এর কম অংশ R&D-তে ব্যয় করছে। এটি অত্যন্ত সীমিত, যা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে। যদি সরকার এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ায় এবং বেসরকারি সেক্টরের অর্থায়নও যুক্ত হয়, তাহলে নতুন উদ্ভাবন দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু সহনশীল ফসলের উন্নয়ন, উচ্চফলনশীল নতুন প্রজাতির ফসল এবং কীট-পোকা ও রোগের পূর্বাভাস ব্যবস্থার মতো উদ্ভাবন কৃষকদের সরাসরি সহায়তা করতে পারে।
তবে শুধুমাত্র নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেই কাজ হবে না। কৃষকদের এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে উৎসাহিত ও সক্ষম করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে ক্লাইমেট-স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা, রিয়েল-টাইম আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং মোবাইলভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম যা কৃষকদের সময়মতো প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করে। বেশ কিছু আফ্রিকান দেশ ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে পদক্ষেপ শুরু করেছে। তারা বুঝতে পারছে, প্রযুক্তি গ্রহণ ও ব্যবহার বৃদ্ধি করলে কৃষিতে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, চলতি বছরের শুরুতে বোৎসওয়ানা নিজস্ব স্যাটেলাইট চালু করেছে। এর মাধ্যমে কৃষিতে রিয়েল-টাইম তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে, যা রোগ ও কীটপোকা শনাক্তকরণ, সেচ পরিকল্পনা এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি শুধু উদ্ভাবন নয়, বরং কৃষকের জীবনমান উন্নয়নের এক সরাসরি পদক্ষেপ।
অতএব, আফ্রিকান দেশগুলোকে কৃষি R&D তে বিনিয়োগ বাড়ানো, বেসরকারি সেক্টরকে উৎসাহিত করা এবং কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষম করা এক সঙ্গে করতে হবে। এই ত্রিপাক্ষিক প্রচেষ্টা ছাড়া আফ্রিকায় কৃষিক্ষেত্রে টেকসই ও স্থিতিশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করা কঠিন।
আফ্রিকার কৃষি খাত দ্রুত পরিবর্তনের মুখোমুখি। নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন গ্রহণের জন্য শুধু কৃষকদের কাছে সেগুলো পৌঁছে দেওয়া যথেষ্ট নয়। সরকারগুলোকে আরও ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কৃষকদের আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি করা। অর্থনৈতিক সহায়তা কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও আধুনিক পদ্ধতিতে কাজ শুরু করতে উৎসাহিত করবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলমান প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু রাখা জরুরি। এতে কৃষকরা শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে না বরং নতুন পদ্ধতি ও উদ্ভাবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে যেতে পারবে।
তাছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। সড়ক, বিদ্যুৎ, পানীয় জল এবং ডিজিটাল সংযোগের মতো মৌলিক অবকাঠামোতে বিনিয়োগ কৃষিকে আরও কার্যকর ও লাভজনক করে তুলতে পারে। সুসংহত অবকাঠামো থাকলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল সহজে বাজারজাত করতে পারবে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই বিনিয়োগ অপরিহার্য।
মহিলাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। আফ্রিকায় কৃষিকাজের প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক মহিলা কিন্তু তারা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ করতে পারে না। সীমিত জমির মালিকানা, প্রশিক্ষণের অভাব এবং সামাজিক-নীতিগত বাধা তাদের উন্নয়নের পথে বাঁধা সৃষ্টি করে। সরকার যদি মহিলাদের জন্য ক্ষমতাবর্ধন কর্মসূচি গ্রহণ করে, প্রশিক্ষণ ও সুযোগ সৃষ্টি করে, তাহলে তারা কৃষি খাতে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারবে। এর ফলে শুধু মহিলাদেরই নয়, সমগ্র গ্রামীণ অর্থনীতি এবং গৃহস্থালির খাদ্য নিরাপত্তা শক্তিশালী হবে।
যুব সমাজও আফ্রিকার কৃষি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকার যুবসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে। এই তরুণদের উদ্যম, সৃজনশীলতা এবং উদ্যোক্তা মনোভাব খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে তাদের সুযোগ, অর্থায়ন এবং পরামর্শমূলক সহায়তা সীমিত। ফলে তারা পুরোপুরি তাদের সম্ভাবনা ব্যবহার করতে পারছে না। যুবকদের সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা হলে নতুন ব্যবসা, উদ্ভাবন ও উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে। এই কারণে সরকার, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং অন্যান্য অংশীদারদের যুবকৃষক ও উদ্ভাবকদের জন্য প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ সরবরাহ করতে হবে। এতে শুধু ক্ষুধা হ্রাস হবে না, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও নিশ্চিত হবে।
কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুরুর দিকেই নজর দিতে হবে মাটির গুণগত মান ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে। পুনর্জীবনশীল কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ এবং নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারই এর মূল ভিত্তি। তবে এই পরিবর্তন কেবল প্রযুক্তি বা অবকাঠামো উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকলে ফল মিলবে না। কৃষক, বিশেষ করে মহিলা কৃষক ও যুবকৃষকদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সমান গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকায় ক্ষুধার সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন শুধু সঠিক সুযোগ, সহায়তা ও নীতি। মহাদেশের কাছে ইতিমধ্যেই সমাধানের বীজ আছে, এখন সেগুলোকে ফলিয়ে তোলার সঠিক পরিবেশ তৈরি করলেই দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।