জাতিসংঘের বর্তমান ভূমিকা এবং এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রায় সবাই হতাশ। গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতা বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিশ্বসংস্থাটি। এ ছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের এজেন্ডাকে বেশি অগ্রাধিকার দেয় এই সংস্থা। সুতরাং এই সংস্থার গুরুত্ব কতটুকু এবং এটি না থাকলেই বা কী হবে—এসব নিয়ে সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার অনলাইন সংস্কংরণে (৭ নভেম্বর) লিখেছেন সাইমন স্পিকম্যান কর্ডাল।
জাতিসংঘ, ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠিত, আজ বিশ্বব্যাপী দেশ ও মানুষের জীবনে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সংস্থার ভূমিকা বিগত ৮০ বছরে বৈশ্বিক সংকটে পথ দেখানো থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, আন্তর্জাতিক আইন, কূটনীতি, মানবিক সহায়তা এবং শান্তি রক্ষায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্ববাসী সাধারণত এটিকে বৈশ্বিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখে, যদিও এর কিছু কাজ ও সিদ্ধান্ত নিয়মিত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।
তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে গাজা অঞ্চলে ইসরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ায় সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জাতিসংঘ প্রায়শই পশ্চিমা বিশ্বের এজেন্ডাকে অগ্রাধিকার দেয়, যা উন্নয়নশীল দেশগুলো বা গ্লোবাল সাউথের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই কারণে সংস্থাটি ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখোমুখি।
আল–জাজিরার অনলাইন সংস্করণে ৭ নভেম্বর সাইমন স্পিকম্যান কর্ডাল এই সংস্থা এবং এর ভবিষ্যত নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে যে, যদি জাতিসংঘ হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায়, বিশ্বে কী প্রভাব পড়তে পারে।
শরণার্থী ও অভিবাসীদের প্রভাব-
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফিউজি স্টাডিজ সেন্টারের গবেষক জেফ ক্রিসপ বলেন, যদি আগামী শুক্রবার জাতিসংঘ বিলুপ্ত হয়, তবে সোমবারের মধ্যে বিশ্বের শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জন্য তাৎক্ষণিক পুনর্গঠন বা বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করা প্রয়োজন হবে। ক্রিসপ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার পদে কাজ করেছেন এবং তিনি দেখেছেন যে, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত শরণার্থী সমস্যা।
বিশ্বে কমপক্ষে ১০ কোটি শরণার্থী, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি ও অনিয়মিত অভিবাসী রয়েছেন। একক রাষ্ট্র এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম নয়। এজন্য একটি আন্তদেশীয় উদ্যোগ অপরিহার্য। ক্রিসপ জানান, ইতিমধ্যেই দেখা গেছে আন্তর্জাতিক সাহায্য কমছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর ফলে জাতিসংঘ–সমর্থিত শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস পাচ্ছে এবং পুষ্টিহীনতা, সামাজিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যদি সহায়তা আরো হ্রাস পায়, তাহলে শরণার্থীরা আশ্রয়শিবির থেকে শহুরে এলাকায় স্থানান্তরিত হবে। সেখানে তাদের উপস্থিতি শহরের সম্পদ ও পরিষেবার ওপর চাপ তৈরি করবে, যদিও তাদের কোনো দোষ নেই। শরণার্থীরা যত গরিব, তাদের ভ্রমণের ক্ষমতা তত সীমিত। জাতিসংঘ না থাকলে রাষ্ট্রগুলো শরণার্থীদের সঙ্গে যে কোনোভাবে আচরণ করলেও তার জন্য আর জবাবদিহি থাকবে না।
ক্রিসপ উল্লেখ করেন, এতে একতরফা পদক্ষেপের মার্কিন মডেলের বিস্তার ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ গাজা মানবিক ফাউন্ডেশন, যা ইসরায়েল-মার্কিন সহযোগিতায় মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেয়, এমন শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসতে পারে। এছাড়া জাতিসংঘ এবং এর সহযোগী সংস্থায় কর্মরত হাজার হাজার মানুষও তাদের চাকরি হারাবে, যা মানবিক সেবা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে।
আন্তর্জাতিক আইন ও আদালতের প্রভাব-
সাবেক সার্ব নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের মামলার প্রধান প্রসিকিউটর, যুক্তরাজ্যের আইনজীবী জিওফ্রে নাইস বলেন, বৃহত্তর রাষ্ট্র বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সার্বভৌমত্বের কাছে আন্তর্জাতিক আইন সব সময়ই দ্বিতীয় স্থানে থাকে। আইসিজে (আন্তর্জাতিক বিচার আদালত) এবং আইসিসি (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত)-এর মতো সংস্থার প্রভাব ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এই সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করে।
নাইস বলেন, “যখন আমরা জাতিসংঘ বিলুপ্তির আইনি প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি, তখন আমরা একটি ইতিমধ্যেই চলমান প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছি। আগে মহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো বিলীন হয়েছে। লিগ অফ নেশনস এর স্পষ্ট উদাহরণ।”
তিনি আরো বলেন, জাতিসংঘের রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে এবং এটি পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। সংস্থার তহবিলের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। যদি এটি ঘটে, তবে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো পুনরায় শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের ওপর নির্ভর করে (বিশুদ্ধ ওয়েস্টফালিয়ান রাজনীতি) চলবে।
তবুও, আন্তর্জাতিক আইন বিলুপ্ত হবে না। নাইস উল্লেখ করেন, স্বাধীন এনজিও এবং অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো জাতীয় আদালত ব্যবহার করে অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংস্থা আল-হক ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে বিভিন্ন মামলার মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় আনছে।
এছাড়া চীনের জোরপূর্বক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও রোহিঙ্গা নির্যাতনের মতো ঘটনায় আন্তর্জাতিক আদালতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
নাইসের মতে, আন্তর্জাতিক আদালতগুলো সম্ভবত টিকে থাকবে এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে আইন থাকবে। কিন্তু আইন প্রয়োগের দায়িত্ব ক্রমবর্ধমানভাবে রাষ্ট্র, করপোরেশন এবং সুশীল সমাজের ওপর চাপিয়ে পড়বে। এটি অপ্রত্যাশিত এবং ভারী বোঝা, তবে বাস্তবতা হিসেবে এটি বহন করতে হবে।
শান্তি রক্ষার দায়িত্ব-
জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব রমেশ ঠাকুর বলেন, একতরফা শান্তি রক্ষা প্রকৃতপক্ষে শান্তি রক্ষা নয়, বরং এটি দখলদারিত্ব। এজন্য দেশগুলো এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলে বা আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো বহুপক্ষীয় ম্যান্ডেট খুঁজে। এমনকি সেক্ষেত্রেও তারা জাতিসংঘের অনুমোদন নিতে ফিরে আসে।
ঠাকুর বলেন, জাতিসংঘ শান্তি রক্ষায় বৈধতা প্রদান করে। এটি যতক্ষণ বৈধতা রাখে, ততক্ষণ কার্যকর থাকে। উদাহরণস্বরূপ, জি২০-এর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সেখানে শক্তিশালী দেশগুলো প্রায়শই জাতিসংঘের কার্যক্রমের আর্থিক ও সামরিক সক্ষমতা রাখে। কিন্তু এর ফলে ধনী দেশগুলো যখন গরিব দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে, তখন জাতিসংঘ এমন অপ্রীতিকর প্রভাব প্রতিরোধের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
তিনি আরো বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের (চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র) বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আইনের বাস্তব প্রয়োগ না হলে তা শুধু আইনি ফিকশন হিসেবে রয়ে যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রভাব-
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও WHO-এর সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন জানান, যদি আগামী শুক্রবার WHO বিলুপ্ত হয়, বিশ্ব তাৎক্ষণিকভাবে এটিকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে। WHO-এর কাঠামো শক্তিশালী, কারণ প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের সমান ভোট রয়েছে। এটি সংস্থাটিকে একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কার্যকর করে।
স্বামীনাথন বলেন, WHO-এর অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। তাদের অনেকেরই ওষুধ বা টিকার অনুমোদনের অবকাঠামো নেই এবং তারা WHO-এর ওপর নির্ভরশীল। এই সংস্থা ছাড়া, অনেক মানুষ অপর্যাপ্ত বা অনিরাপদ চিকিৎসা পাবে, যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
WHO মহামারির প্রস্তুতি ও প্রাদুর্ভাবের সতর্কতা প্রদানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং H5N1 ভাইরাসের মতো রোগের নজরদারি, প্রাথমিক সতর্কতা এবং স্বাস্থ্য নীতি নির্ধারণে সংস্থার কার্যকারিতা অপরিহার্য। এছাড়া, টিকা বিতরণে সাম্য নিশ্চিত করতে এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের শোষণ থেকে গরিব জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতেও WHO গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সহায়তা ও কল্যাণমূলক কাজ-
নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক জেমস টমাস বলেন, জাতিসংঘ, WHO এবং USAID সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ ধরনের সংস্থাগুলো বৈশ্বিক প্রভাব, অবকাঠামো এবং তহবিল রাখে, যা ছোট NGO-এর পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
টমাস বলেন, এই সংস্থাগুলো শুধু সহায়তা দেয় না, বরং গ্লোবাল নর্থের (পশ্চিমা বিশ্ব) আখ্যানকে শক্তিশালী করে। এতে উন্নত দেশগুলো প্রভাব বিস্তার করে, আর নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে তাদের নীতি অনুসরণ করতে হয়। সহায়তা বৈশ্বিক এবং স্থিতিশীল করার ক্ষমতা ছোট NGO-এর কাছে সীমিত।
তিনি আরও বলেন, যদি জাতিসংঘ হঠাৎ বিলুপ্ত হয়, তখন ছোট স্থানীয় সংস্থাগুলো শূন্যস্থান পূরণ করতে চেষ্টা করবে। এতে সহায়তা আরও বৈচিত্র্যময় হবে, তবে তা খণ্ডিত, ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত হবে। আসল চ্যালেঞ্জ হবে নতুন কল্পনা ও সমন্বয় তৈরি করা।
জাতিসংঘের হঠাৎ বিলুপ্তি কেবল একটি সংস্থা হারানোর ঘটনা নয়। এটি বৈশ্বিক শান্তি, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনের একটি দীর্ঘমেয়াদী শূন্যতা তৈরি করবে। শরণার্থী, স্বাস্থ্যসেবা, আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ এবং শান্তি রক্ষায় একাধিক দেশ, সংস্থা এবং সুশীল সমাজকে নতুনভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা, মানবিক সহায়তা এবং শান্তি রক্ষায় এটি অত্যন্ত বড় চ্যালেঞ্জ হবে। সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

