ইউরোপের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়তে থাকার সময়েই দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে এসেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, মূলত তেল ও অস্ত্র রপ্তানিকে সামনে রেখে এই সফরের পরিকল্পনা করেছে মস্কো।
পুতিন দিল্লিতে পৌঁছানোর আগেই রাশিয়ার পার্লামেন্ট ভারতের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক চুক্তিকে অনুমোদন দেয়। চুক্তিটি অনুযায়ী দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী পরস্পরের দেশে গিয়ে সামরিক স্থাপনা ও লজিস্টিক্যাল সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে। এতে প্রয়োজনীয় সহায়তা, সরঞ্জাম ও অবকাঠামো ব্যবহারের পথ খুলে যায়।
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের বিপুল বাজার এবং কৌশলগত অবস্থানের সুযোগ কাজে লাগাতেই রাশিয়া এই ঘনিষ্ঠতার দিকে আরও ঝুঁকছে। ১.৪ বিলিয়নের বেশি জনসংখ্যা, আঞ্চলিক গুরুত্ব এবং সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে দিল্লি এখন রাশিয়ার কাছে বিশেষভাবে মূল্যবান অংশীদার। সামরিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সম্প্রসারণ—দুই দিক থেকেই সফরটি মস্কোর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পুতিনের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। দুই দেশের বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি অংশ নেবেন। সফরে বিভিন্ন বাণিজ্য, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সুবিধা–সংক্রান্ত চুক্তি সই হতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো ধারণা করছে।
তবে সফরটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন রাশিয়া ও ভারত দু’দেশই পশ্চিমা চাপের মুখে। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কমানোর জন্য ভারতের ওপর চাপ বৃদ্ধি করেছে, একই সঙ্গে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধের আগে ভারতের মোট তেল আমদানির মাত্র ২.৫ শতাংশ আসত রাশিয়া থেকে, কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং মূল্যছাড়ের সুযোগ নিয়ে সেই হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে পৌঁছায়। এতে ভারত লাভবান হলেও ওয়াশিংটনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে দিল্লি।
চলতি বছরের অক্টোবরে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ—রাশিয়ার তেল কিনে ভারত ক্রেমলিনের যুদ্ধ তহবিলকে শক্তিশালী করছে। এর ফলে ভারতের রুশ তেল কেনা কিছুটা কমে আসে। পুতিনের এ সফরে তেল রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়টি অগ্রাধিকারে আলোচনায় আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সোভিয়েত যুগ থেকেই ভারত রাশিয়ার অন্যতম বড় অস্ত্রগ্রাহক। এবারও পুতিনের সফরের আগে ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর এসেছে যে দিল্লি মস্কো থেকে নতুন যুদ্ধবিমান এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে পারে।
এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়ে রাশিয়ায় শ্রম সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ভারতীয় দক্ষ কর্মী নিয়োগের সম্ভাবনাও পর্যালোচনা করছে মস্কো। একই সঙ্গে এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে পশ্চিমা অবরোধের পাল্টা কূটনৈতিক বার্তা দিতেও আগ্রহী রাশিয়া। বিবিসি বলছে, পুতিনের এই সফরে সেই রাজনৈতিক ইঙ্গিতও দৃশ্যমান।
তিন মাস আগে চীন সফরে গিয়ে পুতিন, শি জিন পিং এবং নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে ছবিতে ধরা দিয়েছিলেন। বিশ্লেষক আন্দ্রি কোলেসনিকভ মনে করেন, ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া রাশিয়ার জন্য বড় ক্ষতি, কিন্তু দিল্লির সঙ্গে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও শ্রমখাতে নতুন সমঝোতা রাশিয়ার জন্য বিকল্প পথ তৈরি করতে পারে। এই সফর ঠিক সেই কৌশলকেই শক্তিশালী করে।

