ইতালির তাস্কানি প্রদেশের অতি মনোরম একটি পাহাড়ি গ্রাম-কর্টোনা। এ গ্রামটি শুধুমাত্র তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয় বরং এর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের জন্যও খ্যাত। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর, পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের প্রথম আলোর খেলা এবং চারদিকে ছড়িয়ে থাকা সোনালী ফসলে পরিপূর্ণ ক্ষেত-এ যেন এক স্বপ্নের ক্যানভাস, যা প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটককে আকৃষ্ট করে। কিন্তু এই বাঙালি কন্যা, যিনি এ গ্রামে এসেছেন তাঁর গল্পটি ভিন্ন।
তিনি আসেন বাঙালির এক সাদাসিধে জীবনের কথা মনে রেখে। একজন তরুণী, যার চোখে আশা এবং বুকের মধ্যে সাহস, ঝোঁকের বশে তিনি ছুটে যান বিদেশে-নতুন এক অভিজ্ঞতার সন্ধানে। একটি দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু করতে কখনো কখনো ভয়ের চেয়ে ঝোঁকের বেশি প্রয়োজন। এভাবেই তাঁর ইতালীয় সফর শুরু হয় কিন্তু কোথাও ভাবেননি যে তিনি একদিন কর্টোনার মত একটি রহস্যময় ও ঐন্দ্রজালিক গ্রামে পৌঁছে যাবেন।

কর্টোনার মাটিতে পা রেখে, তাঁর মনে হয় যেন তিনি অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছেন। এখানকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, সবুজ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঝরনার কণ্ঠস্বর এবং শীতল বাতাস-এসব যেন এক নতুন সুরের সঙ্গীত। প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে তিনি আবিষ্কার করেন মানুষের আন্তরিকতা, যা তাঁকে এক অন্যরকম শান্তি দেয়। গ্রামবাসীদের হাসিমুখ, তাঁদের জীবনযাত্রার সরলতা-এটি যেন এক নতুন ভুবনে প্রবেশের চিহ্ন।
গ্রামে পৌঁছানোর পর প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর জন্য স্মরণীয়। একটি ছোট্ট ক্যাফেতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ শুরু করেন। সেখানে তিনি পরিচিত হন প্রথাগত ইতালিয়ান খাবারের সঙ্গে, যা তাঁকে ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা দেয়। পাস্তা এবং পিজ্জার পাশাপাশি, তাজা মৌসুমি সবজি, স্থানীয় মদ এবং মিষ্টান্নগুলো তাঁকে বিমোহিত করে। গ্রামবাসীরা অতি আন্তরিকভাবে তাঁকে তাঁদের খাদ্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানান এবং তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে।
একদিন, গ্রামে অনুষ্ঠিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে, তিনি অনুভব করেন স্থানীয় সংস্কৃতির গভীরতা। সেখানে শোনা যায় লোকগান, যেটি শত শত বছরের ঐতিহ্যকে বহন করে। গ্রামীণ নৃত্য, বাদকদের সুরেলা সঙ্গীত এবং উল্লাসে ভরা মানুষের সমাগম—সব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ। তিনি ভাবেন, “এটা কেবল একটি উৎসব নয় বরং একটি সভ্যতার অংশ, যেখানে মানুষের হৃদয় আর সংস্কৃতি একসূত্রে বাঁধা।”
কর্টোনার এই অভিজ্ঞতার মধ্যে, তাঁর মাঝে জন্ম নেয় নতুন ভাবনা। তিনি উপলব্ধি করেন যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নতুন কিছু শেখার সুযোগ রয়েছে। নতুন সংস্কৃতির মধ্যে প্রবেশ করে তিনি বুঝতে পারেন, জীবন শুধুমাত্র একটি যাত্রা নয় বরং এক খোঁজ। এক খোঁজ যার মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের সত্তার গভীরতা এবং জীবনের অর্থ। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে, তিনি তাঁদের জীবনযাত্রার পেছনে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো শোনেন। একজন বৃদ্ধা, যিনি নিজের হাতের তৈরি কাপড়ের জন্য পরিচিত, তাঁকে বলেন, “প্রকৃতির সঙ্গেই আমাদের জীবন জড়িত, আমরা যার সাথে থাকতে পারি, তাই আমাদের সংস্কৃতি।”

এভাবেই কর্টোনা হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এখানে এসে তিনি উপলব্ধি করেন, জীবনের পথে হাঁটতে গিয়ে কখনো কখনো অচেনা জায়গায় পৌঁছানোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কর্টোনার পাহাড়গুলো, নদীগুলো এবং সেখানকার মানুষগুলো, সবকিছু মিলিয়ে তাঁকে নতুন চোখে জীবন দেখার প্রেরণা জোগায়।
এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়; বরং এ গল্পটি প্রতিটি মানুষের জন্য। নতুন কিছু আবিষ্কার করতে গেলে আমাদের সকলকে আমাদের সীমানা অতিক্রম করতে হবে। কর্টোনা তাঁকে শিক্ষা দেয় এবং কখনো কখনো আমাদের জীবনকে রঙিন করার জন্য ঝোঁক ও সাহসের দরকার হয়। এই পর্যায়ে এসে এই বাঙালি কন্যা বুঝতে পারে, কর্টোনা তাঁকে শুধু সৌন্দর্যের সন্ধানে আনেনি বরং জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে।
তাহলে, কর্টোনা-পাহাড়ের কোলে একটি গ্রাম-কেবল একটি ভ্রমণ স্থল নয় বরং এটি একজন বাঙালি কন্যার নতুন জীবনের খোঁজে এক মূল্যবান দিগন্ত। যেখানে তিনি শিখেছেন, জীবনের এই যাত্রায় প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতে হয় এবং সর্বদা নতুন কিছু শেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।

