মোহাম্মদপুরের এক পুরোনো বাড়ি। বাবার মৃত্যুশয্যায় আমার সামনে উন্মোচিত হলো শতবর্ষ পুরোনো এক রহস্য। বাড়ির কোনায় রাখা কাঠের সিন্দুক, যার দিকে আমি এতদিন কেবল একনজর তাকিয়েছি। সেটির গভীরে যে এমন এক বিস্ময় লুকিয়ে আছে, তা কখনোই জানতাম না। বাবা মৃত্যুর মুহূর্তে সিন্দুকটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এটি আমাদের পরিবারের উত্তরাধিকার। তার বিশ্বাস, এই সিন্দুকের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অলৌকিক দরজা। যা সময় ও স্থানের সব সীমা ভেদ করে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়।
বাবার মুখে গল্প শুনতে শুনতে শৈশবের সেই কথাগুলো মনে পড়ল। শুনেছি, ইরান থেকে এক অলৌকিক ক্ষমতাধর পীর কুমিরের পিঠে চড়ে চট্টগ্রামে অবতরণ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গেই এলো এই সিন্দুক। আমার পরদাদার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেই পীর এবং তারপর থেকে এটি আমাদের পরিবারের সম্পদ হয়ে আছে।
বাবা কখনোই সিন্দুকের অলৌকিক ক্ষমতা যাচাই করেননি কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, তবে বাবার মৃত্যুর পর সিন্দুকটি নিয়ে কৌতূহল বাড়তে লাগল। এক শুক্লা দ্বাদশীর রাতে সাহস করে সিন্দুকের সামনে দাঁড়ালাম। হঠাৎ ঘর ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল। সামনে দেখা দিল এক অলৌকিক দরজা। যখন চেতনা ফিরে পেলাম, নিজেকে আবিষ্কার করলাম ১৩ শতকের এক আসরে-জালালউদ্দিন রুমির মজলিশে।
এরপর থেকেই শুরু হলো আমার সময় ও স্থান ভ্রমণের নেশা। রুমি, অ্যারিস্টটল, শাহজাহান-ইতিহাসের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু একবার ভুল করে সিন্দুককে গন্তব্য ঠিক করতে বলায় আমি গিয়ে পড়লাম এক ভয়ংকর বাস্তবতায়। সেখানে এক নিষ্ঠুর শাসক তার প্রজাদের ওপর চালাচ্ছে নির্মম অত্যাচার। শিশুহত্যার বিভীষিকা দেখে শিউরে উঠেছিলাম। নারীরা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে, সন্তানদের প্রাণ বাঁচাতে।
সেই নিষ্ঠুর শাসক ছিল ফেরাউন। তার রাজ্যে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ফিরে এলাম বর্তমানকালে। কিন্তু বাস্তবতাও ক্রমেই হয়ে উঠছিল অনিরাপদ। ২০১৮ সালের পর থেকে দেশের পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। আমার প্রেমিকা তিতলি ছিল আন্দোলনের এক সাহসী সৈনিক। আমরা যখনই কথা বলতাম, বুঝতাম তার ভেতর লড়াইয়ের এক অদম্য স্পৃহা।
কিন্তু একদিন বাস্তবতা আমার সামনে নেমে এল ভয়াবহ নির্মমতায়। তিতলির মৃত্যুর খবর আমাকে একেবারে ভেঙে দিল। ৩১ জুলাইয়ের সেই সন্ধ্যায়, ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখি টিভি সেন্টারের সামনে পড়ে আছে তিতলির রক্তাক্ত মরদেহ। তার প্রাণ গেছে আন্দোলনের মিছিলে।
তিতলির মৃত্যু যেন আমায় ফেরাউনের গল্পে ফিরিয়ে নিল। হাজার বছর আগের শিশুহত্যার সেই বিভীষিকা যেন আমার চোখের সামনে পুনরায় উপস্থিত হলো। শুধু তখনকার শাসকের নাম ছিল ফেরাউন, আর আজকের শাসক ক্ষমতার জন্য তিতলির মতো নিষ্পাপ তরুণ-তরুণীদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে।
আমার পৃথিবী ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসে। সিন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সব ছেড়ে একবারে চলে যাই কোনো অন্য সময়ে, অন্য জগতে। কিন্তু বাস্তবের জঞ্জাল আর স্মৃতির ভার থেকে কি সত্যিই মুক্তি পাওয়া যায়? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাই না।
এই তো আমার যাত্রা-এক অলৌকিক সিন্দুক, নিষ্ঠুর রাজা আর তিতলির স্মৃতি নিয়ে একা এক অশেষ বেদনার গল্প।

