‘আকাশ বাড়িয়ে দাও’ এটি (১৯৮৭) সালে মুহম্মদ জাফর ইকবালের রচিত একটি উপন্যাস।
কাহিনী সংক্ষেপ-
ছোট কলেবরের একটা বিয়োগান্তক উপন্যাস। আর উপন্যাসের চালিকাশক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বললে আশাকরি অত্যুক্তি হবে না। যে কোনো যুদ্ধই স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও তার ব্যতিক্রম না। নয় মাস যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশিদের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এক ধরনের স্বপ্ন লালন করতেন মনের মধ্যে। কিন্তু পরবর্তিতে দেখা যায় সেগুলো আর বাস্তব রূপ পায় না।
আর এভাবেই মুক্তিযুদ্ধফেরত যোদ্ধারা বিভিন্ন ধরনের মানসিক সংকটের মধ্যে দিয়ে সময় পার করতে থাকেন। বিশেষ করে যারা কম বয়সে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাদের মনের ওপর মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ঘটনা প্রবাহ একটা বিরাট ছাপ রেখে যায়। তাই অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। যুদ্ধফেরত অস্ত্রও তাদের হাতে ছিল তাই যে কোনো কিছুই তারা করে ফেলার ক্ষমতা রাখতো।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে কত মানুষের মনে যে কত অপরাধবোধ জমা হয়েছিল তার আসলে সীমা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক তরুণই হাইজ্যাকিংয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছিল। তাদেরই একজন বাবুলের ভাষায়- ‘আসলে আমি নষ্ট হয়ে গেছি- অন্যায়কে আর অন্যায় মনে হয় না। দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে আমি আলবামাতে চান্স পেয়েছিলাম। তখন যায়নি, বুকের ভেতরে একটা দেশপ্রেম। দেশ স্বাধীন হলো, এটা করবো, ওটা করবো, দেশ গড়বো। হায়রে দেশপ্রেম।’
এ সেই বাবুল যার কবিতার প্রতি ভারি দুর্বলতা রয়েছে। এমনকি বাবুল লুকিয়ে লুকিয়ে দু/একটা কবিতাও লিখতো। কিন্তু যুদ্ধের কয়টা মাসের নিদারুণ অভিজ্ঞতার চাপ আর বর্তমান মানসিক শূন্যতা ওকে দিশেহারা করে তুলেছিল। স্বাধীনতার পর পর ঘরে ফিরে এসেও নিজের ভেতর অনেকগুলো পরিবর্তন টের পাচ্ছিল, যার অনেকগুলোর গতি ভয়ানক মারাত্মক।
বাবুল ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের পর এম আই টি থেকে এসিস্ট্যান্টশিপের অফারও পেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সেই বাবুলই হাইজ্যাক করতে যেয়ে ক্ষুব্ধ জনতার হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দেয়।
তরুণেরা বিভিন্ন কারণে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। গল্পের নায়ক আমিন শুরুতে এটাকে তার রাজনৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ মনে করলেও পরবর্তিতে বুঝতে পারে এটা ছিল সাময়িক আবেগ। আবার রহমান ভাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন রাজনৈতিক চেতনার জন্য।
তাই তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি এসেও আশ্চর্যরকম ধীর-স্থির থাকতেন। পাকিস্তানি ক্যাম্পের অত্যাচারের বর্ণনা আছে এই বইতে। এরপর সেই অত্যাচার থেকে কাকতালীয়ভাবে বেঁচে ফিরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমিন হয়ে গেলো এক ভিন্ন মানুষ। এমন সব গেরিলা অপারেশনের নেতৃত্ব আমিন দিয়েছিল যার গল্প প্রচলিত ছিল মানুষের মুখে মুখে।
এরপর আমিনের অনিরাময়যোগ্য রোগ ধরা পড়ে কিন্তু প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়মে তার জীবনে আসে প্রেম। জেসমিনকে বাঁচাতে গিয়ে আমিন কিছু কথা বলে যেগুলো আসলে বাংলাদেশ মেয়েদের সামগ্রিক অবস্থারই বহিঃপ্রকাশ- ‘এদেশে মেয়ে হয়ে জন্মালে এসব অপমান দু/একবার সহ্য করতেই হবে। অপমানটা আসলে তোমার না- অপমান এই সোশ্যাল স্ট্রাকচারের।’ এরপর দ্রুতই সেই প্রেম পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু পরিণতি পায় কি?
ছোট কলেবরের একটা উপন্যাস কিন্তু এটা একবার পড়লে মাথার মধ্যে পুরো কাহিনিটা গেঁথে যায়। পাঠককে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে গেরিলা অপারেশনে এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তরুণদের লাগামহীন কর্মকাণ্ডে। আর অবশ্যই প্রেমও এই উপন্যাসের অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ। সর্বোপরি মানুষের বেঁচে থাকার এক আকুল আকুতি- আকাশ বাড়িতে দাও।

