ভাঙা পুকুর ঘাটটায় শ্যাওলা পড়ে গেছে। অর্ধেক তো নেবে গিয়েছিল গেল বর্ষাতেই। সমস্ত ঘরদোর ভেঙে আসছে। সামনের বর্ষাতে যা আছে তাও বোধহয় মিশে যাবে পুকুরপাড়ের সঙ্গে। সাত সকালে কিংবা মধ্য দুপুরে যখন-তখন ইটগুলো খসে খসে পড়ছে। কখন যে কার মাথায় গিয়ে লাগে, কখন কার করোটির ধার ভেঙে খুলির ভেতরে অনুপ্রবেশ করে – কে জানে!
এক্ষুনি যেন পাগলা হাওয়ার দম ফিরবে, আর তাতে ওলটপালট হবে সমস্ত ভূলোক।
অবশ্য তাতে দম ফিরে পাবে উঠোনের এক কোণে থাকা ক্ষয়িষ্ণু আতাগাছটা। গত তিন মৌসুমে আতা ধরা তো দূরের কথা ফুলের চিহ্নেরও দেখা মেলেনি। উঠোনে পায়চারি করা রাতা মোরগটা ডানা ঝাপটিয়ে ঢালু জায়গাটার উপরে উঠে এসে তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে। হাড়িভাঙা আমগাছটার ছায়া ততোক্ষণে সমস্ত পুকুরপাড় আর জলের অর্ধেক অবধি উজাড় করে দেয়।
সোনালু আর হিজল ফুলের পাপড়িতে ভরে যাওয়া জলের উপরিভাগে হাওয়ায় মৃদু ছন্দপতন হয়। বাণী তখন রসুইঘর থেকে বাসন-কোসন নিয়ে ছোটে পুকুর ঘাটে। ভাঙা পুকুরঘাটের পাশেই গেল বছরের কার্তিক মাসে ঝড়ে ভেঙে পড়া কাঁঠালগাছটার কাণ্ড দিয়ে হিরণ অস্থায়ী ঘাটটা বানিয়ে দিয়েছিল। পূর্বের ঘাটটি পুরোপুরি ধ্বংসাবশেষ হয়ে পড়ে আছে পাশে।
ওখানটায় দাঁড়ানো তো দূরে থাক উবু হয়ে বসাও যায় না। বাণী বিক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে বাসন-কোসন আর থালায় ছাই লাগায়। হাতের কনুই অবধি হাঁড়ির কালি লাগে। অতঃপর তা আঁচলের ধার অবধি ছড়িয়ে পড়ে। স্থির হয়ে বসতে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বাণী। আর তখনই জলে ভাসতে শুরু করে বাসন মাথায় আঁটানো শুদ্ধ হাঁড়িটি। বিক্ষিপ্ত হয়ে দুলতে থাকা হাঁড়িটা সাঁতরায়। যতক্ষণে বাণী গুটিয়ে এসে বসে ততোক্ষণে বাতাসে সৃষ্ট জলতরঙ্গে হাঁড়িটা পুকুরের গভীরে চলে যায়।
কাঁঠাল ঘাটটার পাশেই গেঁথে রাখা বাঁশের কঞ্চিটা হ্যাঁচকা টানে তুলে নিয়ে জল নাড়ায় বাণী। কঞ্চির অগ্রভাগ হাঁড়ির গায়ে লাগলেও তাতে হাঁড়িটা পেছনে না এসে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তখনই ধপ্ করে রসুইঘরের ধারের গাছটা থেকে নারিকেল পড়ার শব্দ শোনা যায়। প্রথমে সে-শব্দে চমকে ওঠে বাণী। দ্বিতীয়ত, নারিকেল পড়ার শব্দটার চেয়ে বাণীর সমস্ত মনোযোগ এখন হাঁড়ির দিকে। সে-হাঁড়িটা এখন হাত ফসকে জলের মধ্যমণি হয়ে ভাসছে।
উঠোন থেকে মহাদেব তখন ‘মা দেইখে যাও। শিয়লে মোরগ লইয়া পলাইছে! তোমার রাতা মুরগাটা।’ এবার যেন বাণীর ব্রহ্মতালু অবধি ক্রোধ উঠে যায়। হাতের কাছের বাসন-কোসন, জলে ভাসা হাঁড়ির মায়া আর নারিকেলের আশা ছেড়ে সে ছুট লাগায় খোঁয়াড়ের দিকে। মহাদেব ততোক্ষণে শিয়ালের পেছনে ছুটে গেছে। কিন্তু মোরগ ধরা সেই শিয়াল কি আর ত্রিসীমানার মধ্যে আছে! বাতাসের পালে ছুট লাগানো শেয়ালের ছায়াও দেখা যায় না।
সব হারানোর শোকে বাণী তখন উঠোনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তার সাধের তেজি রাতা মোরগটার পালক তখন
এখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে। তার রাগ, হতাশা, ক্রোধ সমস্ত এসে জুড়ে বসে গলায়। দীর্ঘশ্বাসের গলায় সে বলে ওঠে, ‘ও ভগবান, তোর চোখ কি আমায় দেহে না? আমার হইলো যত জ্বালা। বেবাকটি কি এমনেই যাইবে!’
মহাদেব অবশ্য এরপর খালি হাতে ফেরে না। শেয়ালের ছায়ার সঙ্গে উথালপাতাল যুদ্ধ করে সে নিয়ে এসেছে শেয়ালের দাঁতালো ছিন্নপায়ে রাতা মোরগটির রানের অর্ধাংশ, মোরগের পেটের বিচ্ছিন্ন আঁতুড়ি, মাথার ওপরে তাজের মতো ঝলসানো খুবলানো বিধ্বস্ত ঝুঁটি।
ছুটন্ত শেয়ালটা হয়তো তখন হোগলার ঝোপে বসে স্বস্তিতে আহারে মত্ত ছিল। বেমক্কা হইহই রবে এগিয়ে নিরেট বাধা সৃষ্টি করে মহাদেব। খণ্ড-বিখণ্ড বিক্ষিপ্ত মোরগটাকে দেখতে পেয়ে বাণীর রাগ যেন আরো চাগাড় দিয়ে ওঠে। তার চোখে ভর করে শ্রাবণের বাদলার মতো বিভ্রান্ত অশ্রু। সমস্ত রাগ গিয়ে আছড়ে পড়ে মহাদেবের ওপর। মহাদেব ততোক্ষণে রাতা মোরগের ভগ্নাংশ ছুড়েই পালিয়ে যায়।
ফের পুকুরের ঘাটে গিয়ে বাসনকোসন একাকার করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে বাণী। এগুলো ধোঁয়া ছাড়া নিস্তার নেই তার। কে কাজ করে দেবে? সব তো চলছে এভাবেই। সূর্যপুরী আমগাছটা জুড়ে সূর্যের কণা লুকোচুরি খায়।
‘ও মহাদেব, জলদি আয়। ওই মহাদেব, জলদি আয় কলাম। শিগগির আয়।’ বাণী তারস্বরে ডেকে গেলেও মহাদেবের তখন আর পাত্তা কোথায়? সে ছুটছে তখন মজুমদারদের বাড়ির দিকে। রসুইঘরের ধারের পুঁইয়ের মাচায় বসা দোয়েলটি একনাগাড়ে শিস বাজিয়েই যায়। বাণীর ততোক্ষণে বাসনকোসন, সানকি, হাঁড়ি-পাতিল সব ধোয়া শেষ। কিন্তু তখনো ডেগটা ভাসছে জলের বুকে। অর্ধেকটুকু উঠিয়ে রসুইঘর পর্যন্ত পৌঁছাতেই বাণী যেন হাঁফ ছাড়ে।
বাঁশের মিটসেলফের মাথায় তোলে ডেগ আর বাসনকোসন। তাতেই যেন পুনরায় হাঁফ ধরে যায় তার। পুনরায় কাঁঠালকাণ্ডের ঘাট অবধি নেমে বাকিগুলো তুলতেই, ঝকঝকে রোদের মাঝেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। ‘ধুরো হেদুর পোলা। বাদলা নামার আর সময় পাইলি না।’ সামনের ঘর থেকে তখনই গলা শোনা যায় বিধুচরণের। এই ঝুমবৃষ্টিতে বাণী আর কোথায় যায়? মানকচুর গোড়া থেকে ততোক্ষণে মানকচুর ডগা তুলে নিয়ে সে মাথায় চাপিয়েছে। বাসনকোসন তুলতে গিয়ে সে টের পায় পিঠ পর্যন্ত ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। মানকচুর ডগা আর কত সামাল দেবে এই জোর বাদলা। বৃষ্টির দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই বাণী ভিজতে ভিজতে হাঁড়ি-পাতিল বাসনকোসনসহ ছোটে রসুইঘরের দিকে।
রসুইঘরের দাওয়ায় আসতেই বাদলায় পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া জায়গাটিতে আচমকাই পা হড়কায় বাণী। মুহূর্তেই ধরণিতল। পায়ের গোড়ালিতে এসে ঢোকে বাঁশের কঞ্চিটা। আর সঙ্গে সঙ্গেই অস্ফুট চিৎকার। বিধুচরণ তখন ভেতরের ঘরে বসে উবু হয়ে কাগজপত্র দেখছিল। বাণীর চিৎকারের সঙ্গে চমকে উঠে ধেয়ে আসে সে। ততোক্ষণে মহাদেব বাণীর হাত ধরে তুলতে লাগলো। বেজায় বৃষ্টিতে মহাদেবও ভিজে একাকার। বাণীর তখন আর কিছু বলার শক্তি নেই। মহাদেব সেই শক্তপোক্ত শরীর তুলতে গিয়ে পুনরায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
গায়ে কাদা লেগে একাকার, তা দেখে বিধুচরণ হাসবে নাকি কাঁদবে সে-কথা ভুলে যায়। বাণীর হাত ধরে প্রথমে সে ওঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এরপর আবার তুলতে গেলে বাণী এবার অসুরের গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলে, ‘ধরন লাগবো না, এতক্ষণ বাদে আইলো সোহাগ দেখানোর লাইগা!’ বিধুচরণ তাতে দমে না গিয়ে পূর্ণশক্তিতে নিজের সমস্ত বল হাতে তুলে এনে উঠিয়ে ধরে শরীরটা। আর তখনই ফের তৃতীয়বারের মতো পায়ের ব্যথায় কাতর হয়ে চেঁচায় বাণী।
বিধুচরণ তখন ‘দেখি দেখি’ বলে দেখতে পায়, পায়ের তালুর অগ্রভাগে হুলের মতো ফুটে আছে বাঁশের ত্রিকোণ কঞ্চিটা। ‘এ কি করে বের করবে, এ তো ফোঁড়ার মতো গেঁথে রয়েছে দেখি!’ বিধুচরণ কঞ্চিসমেত পা টেনে ধরে পরখ করে বলে। বিধুচরণের কাঁধে হাত চেপে দাওয়ায় উঠে আসে বাণী। মহাদেবকে বলেকয়ে এক ঘটি জল গরম করে তুলে নিয়েছে বিধুচরণ। কী করবে সে জানে পুরোপুরি।
অতঃপর কোনো প্রকার অপেক্ষা আর উপশমের প্রতীক্ষা, আর যন্ত্রণার উপদ্রবের ভাবনায় না ভেঙে; দাওয়ায় তোলা সকালে নারিকেল মালায় বেটে রাখা হলুদ টেনে নিয়ে কুসুম জলের সাহায্য ছাড়াই হ্যাঁচকা টানে বাণীর পায়ের তলা থেকে খাঁজের মতো কঞ্চিটা আচমকাই তুলে আনে বিধুচরণ। আর তখনই বাণীর অস্ফুট চিৎকারে বৃষ্টির শব্দ থেমে যায়। বিধুচরণ ‘দেহি দেহি’ বলতেই সজোরে লাথি কষায় বাণী। আর সেটা কি বিধুচরণের অণ্ডকোষে লাগে, নাকি লিঙ্গ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় – কে জানে।
কিন্তু তাতেও কর্তব্যবোধ থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না বিধুচরণ। মহাদেবকে বলে রিফিউজি লতার ঝোপ তুলে আনায় বিধুচরণ, অতঃপর পা’টা তুলে নিয়ে তাতে রিফিউজি লতা হাতের তালুতে ঘসে। প্রথমে বাটা হলুদ লাগিয়ে, অতঃপর রিফিউজি লতার রস ডলে, ঠেসে ধরে তাতে গোটা গামছাসমেত গিট্টু টান টান করে মোড়ায়।
বাণীর মোচড়ামুচড়িতেও বিন্দুমাত্র কাজ হয় না। যন্ত্রণায় বিদ্ধ পায়ে সূক্ষ্ম হাতেই মানকচুর রস লাগায় বিধুচরণ। একপর্যায়ে কাটা মোরগের মতো তড়পাতে তড়পাতে থেমে যায় বাণীর সমস্ত আস্ফালন। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে উঠোন-কোণ।
সারা দুপুর গড়িয়ে বিকেল নাগাদ চোখ মেলে বাণী। শিয়রে তখন হারু ডাক্তার। অনন্ত কবিরাজকে ডাকতে গিয়েও পায়নি বিধুচরণ। দিন তিনেক আগে বাক্স-পেঁটরা গুছিয়ে তারা নাকি চলে গেছে ওপারে। বাড়িভর্তি লোকে চিরকাল পরিপূর্ণ অনন্ত কবিরাজের ভিটে দিন তিনেকের ব্যবধানে এখন খা খা করছে। তুলসীতলা অবধি তুলে নিয়ে গেছে। উঠোনে পিঠ টান করে শুয়ে আছে কুকুর দুটো।
হারু ডাক্তার এসেই কিছুক্ষণ চেঁচায়। সেই বাদলার মধ্যেই তার টোল পড়া চেম্বারে না নিয়ে যাওয়ার জন্য কতক্ষণ খিস্তি করে। তারপর মার্কিন কাপড়ের ব্যান্ডেজ দিয়ে বাণীর গোটা পা মুড়িয়ে দেয়। অতঃপর দেড় টাকা ফি নিয়ে আর দেরি না করে সে বেরিয়ে পড়ে। কারণ ফেরার পথে এই ঘুটঘুটে আঁধার রাতের মধ্যেই মুখার্জি বাড়ি হয়ে রোগী দেখে যেতে হবে তাকে। বীরেন মুখার্জির অবশ্য বাঁচার আশা নেই। বয়স নব্বইয়ের কোঠা পেরিয়েছে ম্যালা আগে। আর কদিনই বাঁচবে তা কড়ে আঙুলে গুনে নেওয়া যায়। কিন্তু তার মধ্যেই যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে মুখার্জিরা। পারলে এখনই যেন বুড়োকে চিতায় তুলে দিলেই বাঁচে। গলায় যেন মাছের কাঁটা আটকে আছে।
হারু ডাক্তারকে রাতে খেয়ে যেতে বলে বিধুচরণ। কিন্তু নুনে ভাতে আর মাগুর মাছের ঝোল ছাড়া আজ আর কোনো সালুন নেই। সকালের দুধ অবশ্য আছে খানিকটা। কিন্তু হারু ডাক্তার খাওয়ার অপেক্ষায় নেই। হারিকেন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বিধুচরণ।
সামনের ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে হারু ডাক্তার উঠোনে ডালিমগাছের তলে রাখা সাইকেলটায় উঠে পড়ে। অতঃপর শেষবারের মতো বলে, ‘বীরেন বাবুর অবস্থা কিন্তু খারাপ। রাইতভর টিকবো নাকি ঠিক নাই। ওগো বাড়িত যামু এহন; কাইল বিকেলে বাণীরে আইসা একবার দেইখা যামু নে।’
হারু ডাক্তার চলে যাওয়ার পথের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে বিধুচরণ। তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে হারিকেনটা নিয়ে চারধারে চোখ বুলায়। এরপর বিধুচরণ হাঁটে। বাঁশঝাড়ের দিকে এগোতেই কি অদ্ভুত এক হাওয়ায় তার দেহ-মন মাতাল করে দেয় মুহূর্তে। জ্বলন্ত হারিকেনটা তাতে যেন আরো বেগ পায়। ওপাশের তুলাগাছটার নিচে মাকে কত বছর আগে দাহ করা হয়েছিল। মায়ের মুখাগ্নি করেছিল বড়দা। বড়দা বেঁচে থাকলে হয়তো ঠিকই থাকতো তারা। অবশ্য বড়দা না থাকায় সুরেশদের বেশ সুবিধাই হলো। কোনো পিছুটান আর রইলো না। মেজদা তো বাবা থাকতেই ওপারে চলে গেল। যাওয়ার সময় বাবাকে যখন বলতে গেল, তখন বাবার সমস্ত জমাটবাঁধা রাগ দু-চোখে এসে জমলো। বাবা কেবল বললো, ‘পূর্বপুরুষের ভিটে ছাড়তে একটাবারের জন্যও তোর মায়া লাগলো নারে যতীন?’
মেজদা গিয়েছিল চুয়াল্লিশের শুরুতে। সুরেশরা গেল পঞ্চাশের শুরুতেই। সুরেশরা গিয়েছিল অবশ্য খুলনার কালশিরা দাঙ্গার মাস দুয়েক পরে। আর এখন চলছে ছাপ্পান্ন। বাবা যতই গালি দিয়েছিল মেজদাকে, এখনকার অবস্থা আর পরিস্থিতি দেখলে হয়তো নিজের গায়েই সমস্ত রাগ তুলে নিত। মেজদাই সবচেয়ে ভাগ্যবান ছিল। কারণ মেজদা যখন গেল, তখন জমিজিরেত, টাকা-পয়সা, ঘর-গোয়াল সবই পেল। অথচ সুরেশরা এখনো পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
তুলাগাছটা থেকে ক-হাত দূরেই আমগাছটা ছিল, বাবা মারা যাওয়ার পর ওই আমগাছটাই কেটেছিল বিধুচরণ। জায়গাটা এখন আর আগের মতো ফাঁকা লাগে না। বনতুলসীর ঝাপ মিলেছে ওখানটায়। ওরা চলে যাওয়ার পর আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না এই মাটিতে। মা-বাবা, ঠাকুরদা সব এই মাটিতেই মিশে আছে। মরার আগে বাবার পরম আকুতিটা আজো বাজে বিধুচরণের কানে। ‘যদু, মধু, বিধু আর যাই করিস, সাত পুরুষের মাটি ছাইড়ে কোথাও যাসনে বাপ। কারো হাতে এই ভিটাখান তুইলে দেওয়ার আগে তোগো মরণ যেন এই ভিটেতেই হয়!’ সে-কথা কেবল বক্ষে ধারণ করছিল বড়দাই। দেশের এখন যে পরিস্থিতি তাতে কোথায় গিয়ে উঠবে তাই এখন নিত্য ত্রস্ত করে রাখে বিধুচরণকে। শেষমেশ এই মাটি বুঝি আর কপালে জুটবে না।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই হারিকেন নিয়ে সাঁতলা পড়া ঘাট পর্যন্ত যায় বিধুচরণ। হারিকেনটা আমগাছের ভেঙে যাওয়া ডালে ঝুলিয়ে সন্তর্পণে কাঁপা কাঁপা পায়ে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। হারিকেনের তেজ কেমন কমে এসেছে। ঠিক তখনই ঘরের দাওয়া থেকে মহাদেবের ‘বাবা, বাবা’ শব্দ ভেসে আসে। হারিকেনটা তুলে পা টিপে টিপে উঠোন পেরিয়ে ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়ায় বিধুচরণ। তারপর শান্ত পায়ে ঘরের কাছে এসে মহাদেবকে ডাকে সে। কিন্তু মহাদেবের কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাণী তখনো ঘুমাচ্ছে। বাণীর পাশেই বসে বসে ঝিমুচ্ছে মহাদেব। তবে ‘বাবা বাবা’ শব্দে কে ডেকে উঠলো? মহাদেবের এই ঝিমুনি অবস্থায় তো ডাকার কথা না। বিধুচরণের চোখে এক রহস্যময় বার্তা ছেয়ে যায়।
সাতদিন পেরিয়ে গেলেও বাণী সেরে ওঠেনি। তার পুরোপুরি সেরে উঠতে এগারো দিন লাগে। কিন্তু বাণীর মাথায় তখনো ফের ঘুরছে ওপারের চিন্তা। পশ্চিমের শিমুলতলার জমি আর পুকুরের উত্তরের ধানিজমিটায় এবার আবাদ ভালো হয়নি বিধুচরণের। অতি গরমে এবার বেশিরভাগ ধানই হয়েছে চিটা।
তবে রূপচাঁদের পাশের জমিটায় এবার মকাইয়ের আবাদ করে বেশ ভালোই করেছে সে। ফলনও বেশ ভালো। ধানের আবাদ এবার সবদিকেই খারাপ।
আকালের দিন বুঝি এবার আবার এলো। অবশ্য এসব নিয়ে বাণীর আর কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। তার মনোজগৎ পুরোটা জুড়েই ওপারের কেচ্ছাকাহিনি। ওপারে যাওয়ার পর সে কী কী করবে – সকাল-সন্ধ্যা মহাদেবকে বসে বসে সেসবই শোনায় বাণী। বাণীর দু-চোখে কেবলই ওপারে যাওয়ার স্বপ্ন। একটা ভিটে, সঙ্গে উঠোন, উঠোন লাগোয়া পুকুর, গোয়ালঘর আর রসুইঘর বেয়ে ওঠা পুঁইমাচা। এসবই গেঁথে আছে বাণীর চোখে।
রোজ সকালে আর রাতে খাটে শুয়ে চোখের পাতা নেমে আসার আগে বাণী বিধুচরণকে ওপারে যাওয়ার কথা দুবার করে স্মরণ করিয়ে দেয়। যতক্ষণ রসুইঘরে থাকে, ততোক্ষণ পর্যন্ত তার দৃষ্টি যেন ওপারেই থাকে। যে করেই হোক তাকে ওপারে যেতেই হবে – এই হলো লক্ষ্য। শেষমেশ হয়তো বাণীর আবদারই রাখতে হবে।
সাতসকালেই কাগজপত্র নিয়ে মহকুমা সদরে গিয়েছিল বিধুচরণ। এখন সব জমি নিয়ে যত তোড়জোড়। সমস্ত হিন্দু ওপারে পৌঁছাতে পারলে যেন বাঁচে। ওপাশ থেকে মুসলমানেরাও দেদার এপারে আসছে। পৌষখালী, মনোহরপুর আর কুতুবপুরে মুসলিম লীগের চ্যাংড়াদের হাতে হিন্দুবাড়িতে আগুন দেওয়ার পরে ওপারে চলে যাওয়ার জন্য হিন্দুরা সব মুখিয়ে আছে। আর তাই তহসিল অফিসেও বেজায় ভিড় থাকবে ভেবে সাতসকালেই রওনা দিয়েছিল বিধুচরণ। প্রথম প্রহর বলে ভিড়টাও ছিল অনেকটা কম। বেলা বারোটার আগেই কাজ শেষ করে বাড়ির পথ ধরলো সে। যতক্ষণে গয়েশপুর হাটের কাছে এসে সে ভিড়লো ততোক্ষণে সূর্যটা পশ্চিমে ঠিক কপাল বরাবর।
একে তো ক্লান্তি, দ্বিতীয়ত পিপাসা। আর তৃতীয়ত, সেই সাতসকালে ক’টা পান্তা খেয়ে বেরিয়েছিল সে, তা এতক্ষণে কোন গহ্বরে পৌঁছে কোথায় যে হজম হয়েছে কে জানে। গেল কয়েকদিনে গরমের মাত্রাও অনেকখানি বেড়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের খরতাপ বলে কথা। বাড়ি পৌঁছে চারটা খেয়েদেয়ে যে ঘুমাবে তারও উপায় নেই। তুলাগাছতলায় সবসময় কোনো না কোনো গরুর গাড়ি পাওয়া যায়। অথচ আজ যেন তার নিশানাও নেই।
পিপাসায় গঙ্গাচরণের টোলের ধারে চলে যায় বিধুচরণ। কুয়ার জল একদম তলায় নেমে গেছে। রশি বেঁধেও এই জল তোলার উপায় নেই। পিপাসায় হাঁসফাঁস করে সে। গঙ্গাচরণের দোকানটারও ঝাপ নামানো। এই ভরদুপুরে পুরো বাজারে একটা দোকানও খোলা নেই। গরুর গাড়িরও দেখা নেই। জিরিয়ে না নিয়ে ফের সোজা হাঁটতে থাকে বিধুচরণ।
গগনদের বাড়ির সম্মুখভাগে পৌঁছানোর পরই চলার গতি থেমে যায় তার। জলপানের নিমিত্তে বাড়ির সামনে গিয়ে গগন গগন বলে কয়েকবার ডাকে বিধুচরণ। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাড়ির সম্মুখ-দালানের সামনে শুয়েছিল দুটো কুকুর। পিটপিট করে তাকিয়ে বুঝে নিচ্ছিল আগন্তুকের পরিচয়। বিধুচরণের ‘গগন গগন’ ডাকে কুকুরগুলো সমস্বরে ডেকে ওঠে। বিধুচরণ তবুও ফের ডাকে।
কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চরণ চরণ বলেও দু-দফা ডাকে। বাড়িতে কেউ নেই নাকি? এরা সব গেল কোথায়? বিধুচরণের এদিকে তেমন একটা আসা হয় না। কেবল মহকুমা সদরে যেতে হলেই এই পথটা ধরতে হবে। নয়তো গঙ্গারামপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে। বাড়ির সব গেল কোথায়, ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে বিধুচরণ। বাড়ির সদর দরজায় তালা ঝুলছে।
উঠোনটাও শূন্য। রসুইঘরের দাওয়ায় সজনে গাছটার তলে গগনদের কুকুরটা ঝিমাচ্ছে। রসুইঘরেও তালা ঝুলছে। উঠোনের শেষ কোণের নিমগাছ আর বাঁশঝাড়টা পেরিয়ে ঠাকুরঘরের দিকে এগোয় বিধুচরণ। না ঠাকুরঘরেও তালা ঝুলছে। এরা সব গেল কোথায়? বেড়াতে গেলে বুঝি সব একসঙ্গে যায়? আগে এমনটা দেখেনি বিধুচরণ। বাড়িতে কাউকে না দেখে তৃষ্ণার কথা পুরোপুরিই ভুলে যায় বিধুচরণ। অশ্বথ গাছতলার ঠাকুরঘরের ভেতরের কালীর মূর্তিটা কী আশ্চর্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সম্মুখে যত্রতত্র মোম, তুলসী মালা, বেলপাতা, জবা আর বিবর্ণ দূর্বা ছড়িয়ে আছে। বাইরে থেকে তালা ঝোলানো দেখে দু-হাত কপালে ঠেকিয়ে দুর্গার দিকে প্রণাম করে বিধুচরণ। কেউ বাড়িতে না থাকায় বাড়িটা কেমন যেন রহস্যময় লাগে। বিধুচরণ কাউকে দেখতে না পেয়ে বাড়ির মেয়েদের পুকুরপাড়ের দিকে যায়। সুপারি ও জামগাছের সঙ্গে বাঁশ টানিয়ে তাতে সুপারির খোল টানিয়ে বেড়া টানানো। পুকুরপাড়ের ধারের টগর এবং জোড়া জবাগাছটা ফুলে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। বিধুচরণ দেখলো সদর দরজার সামনে পা বিছিয়ে শুয়ে থাকা কুকুরটি এগিয়ে আসছে। এরপর দু-পা আগের মতো বিছিয়ে কপালটা মাটিয়ে ঠেকিয়ে ঠাকুরঘরের সামনে এসে শুয়ে পড়ে।
সারা বাড়ি কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। মাঝেমাঝে নিস্তব্ধতা মøান করে দিচ্ছে ঘুঘু আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। পুরো বাড়ি খালি করেই বুঝি তারা বেড়াতে গেল? বাড়িজুড়ে গাছে পরিপূর্ণ হওয়ায় ছায়া থাকা সত্ত্বেও বিধুচরণের পূর্ববর্তী তৃষ্ণাটি জানান দেয়। বিধুচরণ উঠোনের এককোণে তুলসীতলার ধারে ফিরে আসে। কুয়াতলায় এসে বিধুচরণ দেখে কুয়ার জল বেশ নিচে নেমে গেছে। যদিও জলের স্তর দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু এই জল তুলবে কী করে বিধুচরণ? পাশে এক মাটির ঘটি বাদে আর কিছুই নেই। ঘটি আর কতখানি পৌঁছাবে। হাত নিচে নামালেও ঘটি দিয়ে জল ছোঁয়ানো সম্ভব নয়। দড়ি থাকলে হতো। ঘটির মুখে দড়ি পেঁচিয়ে নিচে ফেলা যেত। কিন্তু আশপাশে খুঁজেও দড়ির খোঁজ পায় না বিধুচরণ। জলপানে ব্যর্থ হয়ে সে ভাবে, পুরো বাড়িতে একটা লোকও নেই! ফের পুকুরপাড়ে ফিরে যায় বিধুচরণ।
আঁজলা ভরে জল খায়। তীব্র গরম আর ভ্রমণক্লান্তিতে ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল। দশ-বারো দফা আঁজলা ভরে জল খেলেও তেষ্টা মেটে না।
এমন সময় কার যেন শব্দ শুনতে পায় বিধুচরণ। ঘাটলা থেকে উঠতেই দেখে পুরোহিত কৃষ্ণপদ ঠাকুরঘরের তালা খুলছেন। বিধুচরণকে দেখতে পাননি তিনি। বিধুচরণ ঘটিসমেত উঠোনে ফিরে আসে। তাতেও যেন কৃষ্ণপদ টের পান না। বিধুচরণ ‘ও ঠাকুরমশাই’ বলতেই কৃষ্ণপদ পেছনে তাকিয়ে বলেন, ‘আপনে আবার কই থেইকা? মেলাদিন পরে দেখলাম। কই গেছিলেন?’
‘তহসিল অফিসের কামে মহকুমা সদরে গেলাম। আইতে আইতে এই অবস্থা। যা গরম! বাড়ির লোকজন সব কই?’ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে বিধুচরণ। ‘কী কন? ক্যান আপনে জানেন না হেরা তো গেল হপ্তায় সব ইন্ডিয়া গেল। কোন দুনিয়াই থাকেন আপনে।’ কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই বলেন কৃষ্ণপদ। আগে হলে স্তম্ভিত হতো বিধুচরণ। কিন্তু এখন সব স্বাভাবিক।
কিন্তু মুখার্জি বাড়ির সব ইন্ডিয়া চলে গেছে এটা কেমন যেন অসম্ভব মনে হয় বিধুচরণের। ‘কী কন? হেরা ইন্ডিয়া গেল, কিছুই তো জানবার পারলাম না।‘ বিস্ময়টা গোপন করার চেষ্টা করেও গোপন করতে পারে না বিধুচরণ। মুখার্জিদের মতো লোকেরা ইন্ডিয়া চলে যাবে এ তো রীতিমতো অসম্ভব। গগন, চরণ, হরিষরা ইন্ডিয়া চলে গেছে আর সে জানে না – বিষয়টি বিধুচরণের অতি আশ্চর্যের মনে হয়। কৃষ্ণপদ প্রথমে বিরক্তি প্রকাশ করলেও সহসাই বুঝতে পারে বিধুচরণের সবকিছুই অজানা।
তাই ঠাকুরঘর ও সম্মুখভাগ ঝাড়ু দিতে গিয়ে তাঁর গলায় গৃহকর্তার প্রতি তীব্র মায়া আর অনুরাগ ভেঙে আসে। ‘কী আর কমু কন। গেল হপ্তাহে তো চইলা গেল। পুরা বাড়ি খা খা করতাছে। আমিও চইলা যামু দুই সপ্তাহ বাদে।’
গগনরা তথা মুখার্জিরা এ-গ্রাম তো বটেই, আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল। সেই মুখার্জিরাই চলে গেছে – এটা অকল্পনীয় মনে হয়। যেভাবে মানুষ ছুটছে সেভাবে তাতে কজন হিন্দুই বা শেষমেশ থাকে তা দেখার বিষয়। বাণীর কানে এখনো এই খবর পৌঁছেনি। এমনিতেই ওপারে যাওয়ার জন্য ওর যে তোড়জোড় তা আরো কয়েকগুণ বাড়বে নিশ্চিত।
‘আপনেরা এখনো গেলেন না যে?’ পুরোহিত সামনের উঠোনটা সাফ করতে করতে বলেন। ‘আইজ হোক আর কাইল হোক, যামু তো নিশ্চিত। সামনের হপ্তায় দেখবার আসবো। এপারে আর কে থাকবো? আইজ নয়তো কাইল – সবই তো চইলা যাইবো গা।’ হতাশার গলায় বলে বিধুচরণ।
‘কি বাড়ি কি অইয়া গেল। এই বাড়ি আর কদিন বাদেই তো মোসলমানের হাতে যাইবো। ঠাকুরঘর আর ঠাকুরঘর থাকবো না। ওইহানে দেখবেন হয়তো নামাজঘর অইবো। তুলসীতলাও কি আর রাখবো। কর্তাবাবুরা যাওনের সময় সব নিল। কইলো আবার আসবো। কে আর আসবো! হ্যারা তো সবটি লইয়াই গেল। তয় আমি কিন্তু কালীরে ছাড়ুম না। যাওনের সময় লইয়া যামু।’ কৃষ্ণপদ একনাগাড়ে বলে যান। শেষ বিকেল হয়ে আসছে। দড়িতে বাঁধা পিতলের কলসি কুয়ায় ফেলেন কৃষ্ণপদ। জল ভরাট হয়ে গেলে দড়ি টেনে তুলে আনেন।
‘বিনিময় কোন জায়গায় হইলো কিছু জানলেন নাকি ঠাকুরমশাই?’ বিধুচরণ বলে। ‘কই আর ওই চন্দ্ররামপুর। গেলবার তপন কর্তারা যে জায়গায় গেল। তয় যে মোসলমানের লগে বদল অইলো ওই তুলনায় কিছুই পাইলো না। আগে যারা গ্যাছে হেরগো একখান গতি অইছে। কিন্তু আমাগোর আর গতি নাই। তয় মোসলমানের লাভ।’
‘ওইপারে কিছুই নাই, দেখেন গিয়া। এই পাশে বদল কইরে কামের কাম করি দিলো। হিঁদুর কোনো জায়গায় লাভ নাই। এইপারে ছিল ভালা। কিন্তু থাকার আর জায়গা কই? হিঁদুর চিরকালই দুর্গতি।’ ততোক্ষণে পূজার সরঞ্জামাদি প্রস্তুত করে নিয়েছেন পুরোহিত কৃষ্ণপদ। আক্ষেপ করতে করতে বাড়ির পথ ধরে বিধুচরণ।
সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে বিধুচরণের বাড়ি বিনিময়ের অনেকটা বায়না হয়ে যায়। ভাদ্র মাসেই ওরা এপারে চলে আসবে। আর বিধুচরণরা ওপারে চলে যাবে। মদন খুড়োই সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। অবশ্য তাতে তার ভাগ্যেও দেড়শো টাকা গেছে। ওপাশ থেকেও খুড়ো খেয়েছে নিশ্চিত।
খুড়োর সঙ্গে মুসলিম লীগের পাণ্ডাদের বেশ দহরমমহরম সম্পর্ক। একসময় কংগ্রেসের ঝাণ্ডা ধরা খুড়ো এখন মুসলিম লীগের পাঁড় দালাল হয়েছে। সময়ের সঙ্গে একি বিবর্তন, ভাবলেই বিস্মিত হতে হয়। মদন খুড়ো যতটা ভাবছে ততোটা নয়। তাকেও শেষমেশ যেতে হবে। দিনের মধ্যে মুসলিম লীগের পাণ্ডারা যতটা পারছে উসুল করে তুলছে। কিন্তু শেষমেশ মদন খুড়ো থাকতে পারবে কি না সেটাই দেখার বিষয়। যতই দহরমমহরম সম্পর্ক থাকুক না কেন, দিনশেষে সে তো হিন্দুই।
এরই মধ্যে বাণী আর হিরণকে নিয়ে রঘুনাথপুরের জায়গাটিও দেখে এসেছে বিধুচরণ। জায়গাটা বাণীরও বেশ পছন্দ হয়। তবে পছন্দ না হয়েও উপায় নেই। এখন যেভাবেই হোক ওপারে চলে যেতে পারলেই চলে। আস্তে-ধীরে না হয় গুছিয়ে নেওয়া যাবে। সকাল-বিকাল বাণীর ঘ্যানর ঘ্যানর আর রাতদুপুরের স্বপ্নের কথা শুনতে কার বা ভালো ঠেকে!
বাড়িটা অবশ্য মন্দ নয়। দোচালা টিনের দেহাতি বাড়ি। পাশেই পুকুর, দুপাশে একচিলতে করে ক্ষেত। একাংশে সুপারি বাগানের সঙ্গে পেছনে বাঁশঝাড়। কুয়াও আছে একটা। জায়গাজমি বিধুচরণের তুলনায় কম। আর এখানকার মতো জনবসতি নয়। মানুষ কম, তবে পাশেই আরেক হিন্দু নতুন জায়গায় ঘর তুলেছে। পথ দিয়ে হেঁটে গেলে মাঝেমাঝে একটা-দুটো বাড়ি পড়ে। তবে মাইল দেড়েক দূরে জনা নন্দেখালী হাট আছে। সপ্তাহে রোববারে আর বুধবারে হাট বসে। তবে নিত্যদিন সকাল-বিকেল আনাজপাতি মসলা পাওয়া যায়। আরো চার ক্রোশ গেলে মিঠেখালী স্টেশন এবং নদী লাগোয়া গঞ্জ।
নতুন ভিটে, নতুন দেশের স্বপ্নে বাণীর সমস্ত মনোজগৎ আজকাল পাল্টে গেছে। সকাল-বিকেল ঘরদোর সাফ, রান্না, গরু হাঁস মুরগির দেখভালের পিছুপিছু যখনই সামান্য অবসর মিলে তখনই সে বাপ ন্যাওটা মেয়ের মতো বিধুচরণের কাছে এসে ঘুরঘুর করে। অতঃপর আয়েশি গলায় কখনো-সখনো বলে বসে – ‘মিয়াজীরা কী কইলো? ওই বাড়ির পাশের লোকের সঙ্গে আমি কিন্তুক কথা কয়া আসছি। হ্যারা যাওনের সময়ে পান নিবার পারে নাই। যাওনের সময় পান নেওনের কথা কয়ো তো একবার। আরেকটা কথা, ওপারে যাইয়াই কিন্তু আমি প্রথমে হিরণের বিয়া দিমু। লাল শাড়ি পইড়া হিরণের বউ আনমু।’
বিধুচরণের এখন অখণ্ড অবসর। এবার আবাদটাও করেনি সে। ওপারে গিয়ে না-হয় ফের শুরু করা যাবে। ঘরে যা মজুত আছে তাতে আরো মাস পৌনে-দুই চলে যাবে। ততোদিনে ওপারে গিয়ে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর হিরণ তো রায়দের কাছ থেকে কিছু টাকা এরই মধ্যে পেয়েছে। কাজ ছাড়ার সময় মুন্সিদের কাছ থেকেও কিছু টাকা পাবে। ওপারে গিয়ে রায়দের কাজে যদি আবার লেগে থাকতে পারে তাহলে তো একটা গতি হয়েই গেল। অবশ্য রায়দের এখানে যে প্রতিপত্তি ছিল ওপাশে গিয়ে আর কতখানি থাকে তাই ভাবার বিষয়। দলিল কাগজের হিসাব-নিকাশের ফেরে এপাশের রায় বাহাদুর যে ওপাশে গিয়ে ভিখারি হয়ে গেছে সে-চিত্রেরও তো দেখা মিলেছে।
বিধুচরণ ক্যাম্বিসের স্যুটকেসটা ধুয়ে উঠোনে মেলে দেয়। ট্রাংক জোড়া সাফসুতরো করে। ‘শুনো আমি কিন্তু সুপারির ধারে কয়েকটা পানগাছ লাগাইয়া দিমু। যা দাম ওই ধারে পানের।’ বিধুচরণ কেবল শুনে যায় আর মাঝেমাঝে সম্মতিসূচক ‘হ্যাঁ হু’ করে। ‘পুকুরের চাইরপাশে কিন্তু সজনে, নিম আর হরীতকী গাছ লাগাইবা। ওপারে গেলে প্রথম কদিন আমি কিন্তু বিরাম করবো। হিরণের কিন্তু এখনো আওয়ার নাম নাই। চিঠির জবাবখানও দিলো না। জলদি কাইল আরেকখান চিঠি লেখো তো।’ ‘চিঠি লেইখা লাভ কি! ওর তো আরো কয়েকদিন লাগবো। কেবল রায় বাড়ির লোকজন গেছে। ওপাশ থেইকা তো মুন্সিরা আইলো। ওরে তো এমনেও রাখবো না। আগে তো ওর কাছ থেইকা সব বুইঝা নিতে অইবো।’ বিধুচরণ জানে মুন্সিদের খেয়ালখুশিমতো কটা দিন চললেই বাড়তি কিছু টাকা আসবে, তাতে আর মন্দ কী।
বাইরের বৃষ্টিটা কি এখনই নামবে নাকি? নাকি আজ গোটা দিনে বৃষ্টিই হবে না? অনুমান করা যায় না। গত তিনদিন ধরে এমনই মেঘ-রোদের লুকোচুরি চলছে। একবার আকাশ ঘন করে মেঘ আসে তো কিছুক্ষণ পরেই আবার মেঘ ঠেলে রোদ নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। চক্রাখালী যেতে হবে বিধুচরণকে। মেঘ-রোদের এই দোলাচলে গোলাঘর থেকে ছাতাটা নিয়ে বিধুচরণ যখন বের হতে যাবে তখনই হিরণের গলা শোনা যায় বাড়ির বাইরে। চলে এসেছে সে। বিধুচরণ ছাতাটা গুটিয়ে নেয়। আরেকটু পরেই না হয় বের হবে সে।
হিরণ বাপকে দেখেই সঙ্গে আনা ট্রাংক আর বাক্স-পেঁটরা নিচে রাখে। এরপর কুয়াতলায় গিয়ে জল উঠিয়ে মুখ-হাত ডলে নেয়। পুকুরপাড়ে তখন বাণী কাপড় কাচছে। হিরণের গলা শুনে সে কুয়াতলায় কাপড় রেখেই আসে। বিধুচরণ অবশ্য এতটা উচ্ছ্বসিত নয়। তার মনোজগৎ জুড়ে তখনো ওপারে চলার ভাবনা। ‘রায়রা কী কলো রে হিরণ? তরে রাখবো তো?’ বিধুচরণ বলতেই বাণী ক্ষেপে ওঠে। ‘পোলাডা এতদিন পরে বাড়িত আইছে আর শুরু অইছে বুড়ার তড়পানি। ভগবান কি কাউরে না খাওয়াইয়া রাখবো নাকি।’
হিরণ অবশ্য এসবের কসুর করে না। সে বলে, ‘রাখতে চাইলে রাখবো। সবে তো গেল। আগে কয়েকদিন জিরাক। লাগলে আপনাতেই খবর দিবো। তয় কই মুন্সিরা লোক ভালা। আওনের সময়ে গোটা দুইশো টাকাও দিছে। আমারে তো রাখবারও চাইলো। আমি কলাম, আমাগো বাড়ির তো বণ্টন হয়া গেল। আগামী সপ্তাহে চইলা যামু গিয়া। কলো, ওপারে যাওনের কাম কি। এইপারেও যা ওইপারেও তা। নিজের ভিটামাটি আরেকজনরে দিয়া নতুন দেশে যাইয়া উঠনের কাম কি?’
হিরণের কথায় বাণী বেশ বিরক্ত হয়। ‘তর বুঝনের কাম নাই। খালি মনে রাখবি এই দেশ মোসলমানের। অহন ওইপারেই আমাগো দেশ।‘ বাণী আগেই বুঝতে পেরেছিল হিরণ ওপারে যেতে চায় না। গ্রামভর্তি সব ওপারে চলে গেল। পুরো
গাঁও-গেরাম এখন নতুন লোকে ভর্তি তাও সাধ মেটে না। তিনদিন আগেই তো কাশিপুরে তিনজনরে কোপাইয়া মারলো। এদিকে এখন সব নতুন লোক। কোনদিন কার গলায় যে ছুরি চালিয়ে দেয় কে জানে। মনে মনে ভাবে বাণী।
বিধুচরণ বসে পড়ে। কখনো শোনে কখনো বলে। ‘মুন্সিগো কেমন জমি পাইলো রায়রা?’ ‘মুন্সিগো জোতদারি ছিল। তয় আরো আগে বিনিময় হইলে আরো অনেক বেশি পাইতো। মুন্সিরা বুঝবার পারছিল ওরা আর ওখানে থাকবো না। তাই জায়গাজমি কিছু বিক্রি করে হাতে নগদ টাকা রাখছিল। রায়রা তো কোনো জমিই বেঁচে নাই। কিন্তু মুন্সিরা নগদ টাকা হাতে রাখনের লাইগা কিছু জমি ছাইড়া দিছে। আবার এপাশে আইসাও রায়গো মেলা সম্পত্তি পাইলো। ওপারে গিয়া মোসলমানের লাভ অইলেও হিন্দুরা মারাই খাইলো।’ বিক্ষুব্ধ গলায় বলে হিরণ।
বাণী বুঝে নেয় এ আলাপ শেষ হওয়ার নয়। এদিকে ঘরে কেরোসিন ফুরিয়ে গেছে। রাতে কুপি কী দিয়ে জ¦লবে এই চিন্তায় অস্থির সে। ‘তোমার না গঞ্জে যাওনের কথা। এদিকে বাদলা যে নামবো। আইজ কলাম রাইতে কুপি জ্বালানেরও তেল নাই।’ বিধুচরণ আর দ্বিতীয় কিছু না ভেবে উঠে যায়।
ভোর থাকতেই ধুলায় জড়ানো সেতারটা কোলে নিয়ে বসে বিধুচরণ। তখনো আলো ফোটেনি। বহুদিন বাদে এই সেতারটা কোন দেরাজ থেকে বের করেছে তা কেবল বিধুচরণই জানে। বাড়ির সব প্রাণী তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বিধুচরণ প্রথমে গামছায় সেতারের তার থেকে পিনসহ সমস্ত কিছু মুছে সাফ করে। তারপর ঘরের দাওয়ায় পাটি পেতে নেয়। শিউলিতলায় কেউ যেন শুভ্র চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। সারারাত শিউলি ঝরে শিউলিতলাটা কি স্নিগ্ধ আর পবিত্র লাগছে। বিধুচরণ সেতারে তাল তোলে। শরীরজুড়ে রাতে না ঘুমানোর ক্লান্তি ভর করে। সারারাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও একবিন্দু ঘুম আনতে পারেনি বিধুচরণ।
শরীরজুড়ে ক্লান্তির শ্বাস অথচ চোখজুড়ে বিন্দুমাত্র নিদ্রার চিহ্ন নেই তার। সেতারের তারে আঙুলের স্পর্শ পড়তেই গ্যাও গ্যাও শব্দ ওঠে। তারপর মৃদু স্পর্শে সেতারকে যেন বশ করে বিধুচরণ। একসময় এই সেতারকে ঘিরেই কত কি স্বপ্ন বুনেছিল বিধুচরণ। সেসব এখন অতীত। বিধুচরণ চোখ বুজে, তাতেও যদি সামান্য ঘুম পায়। সামান্য নিদ্রা আসে তবে সেতারটা রেখেই সে ঘুমুতে যাবে।
রাগ ভৈরবীর তাল তোলে বিধুচরণ। ধীরে ধীরে ভোর উঠছে। উঠোনের এক কোণে কুকুরটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ডালিমগাছের ডাল থেকে ডালে দুধরাজ আর দোয়েল উড়ে বেড়াচ্ছে। বিধুচরণের শরীরটা কেমন ভেঙে আসছে। ঘরের ভেতরে সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, অথচ বিধুচরণের দু-চোখে কোনো ঘুম নেই। বিধুচরণ একমনে সেতার বাজিয়ে যায়। রাগ ভৈরবী থেকে মালকোষে প্রবেশ করে। রাগ ইমন থেকে রাগ খাম্বাজে ঢুকে পড়ে। তুলসীতলাটি ধীরে ধীরে সূর্যকিরণের আলোয় ভরে যায়। হাত দুটো যেন অবশ হয়ে আসছে বিধুচরণের। কিন্তু থামতে ইচ্ছে হয় না তার।
হাত দুটো যেন এখনই কেটে টুকরো টুকরো হয়ে পড়বে। অতঃপর ধীরে ধীরে শরীরের সমস্ত শক্তি হ্রাস হয়ে আসবে বিধুচরণের। সাঁতলা পড়া পুকুর পাড়ের ধার থেকে কেউ যেন সজোরে চিৎকার করে। কারো যেন আওয়াজ শুনতে পায় বিধুচরণ। কিন্তু বিধুচরণের চোখ জোড়া নিশ্চল হয়ে আসে। এখনই যেন সে ঢলে পড়বে। একের পর এক তান বাজিয়েই চলে বিধুচরণ। সমস্ত শরীরের বেদনা যেন তার চোখে নেমে আসে। বিধুচরণের ভীষণ ঘুম পায়। সারারাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করা বিধুচরণের এখন বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এই ক্লান্তিকর রাত শেষে ভোর আর সকালের মধ্যবর্তী সময়ে সেতারখানা দু-হাতের ভাঁজে রেখে চোখ বুজে কোন ফাঁকে যে বিধুচরণ এলিয়ে পড়ে টের পায়নি কেউ।
বেলা দ্বিপ্রহরের আগেই বাড়ির উত্তরের সীমানায় বিস্তীর্ণ ছায়া বিলানো পুরনো বড় আমগাছটা কাটা পড়ে। তুলসীতলা আর কুয়াতলার মাঝে যতীন, লক্ষ্মণ আর মহাদেবকে নিয়ে সেই মস্ত গাছটা চ্যালা করে খণ্ড খণ্ড করে হিরণ। বাণী তখন ঘরের দাওয়ায় বসে পিটপিট চোখে সমস্ত কর্মতৎপরতা দেখে। তারপর সমস্ত জোগাড়যন্ত্র করে বিধুচরণকে সাজাতে সাজাতে বিকেল দুপুর পেরিয়ে যায়। চোখ দুটো বোজা। ভ্রুর উপরে-নিচে লেগে আছে তিলক আর বাটা চন্দন। তুলসী পাতায় দু-চোখ ঢাকা।
এরই মধ্যেই গাঁয়ের প্রায় সব হিন্দুই ওপারে চলে গেছে। আশপাশের গোটা তিন গ্রামে যে পাঁচ-ছয় ঘর এখনো বাকি আছে, তারাও আজ-কালকের মধ্যে চলে যাওয়ার বন্দোবস্ত করেছে। অবশ্য বিধুচরণের খবরটা শুনে হরিশ, নগেন ছাড়াও পাশের দু-গ্রাম থেকে এসেছে হরেন, কনক, ফটিক, কালীপদ, অনল বাগচী। মদন খুড়োও এসেছে শেষবেলায়। উঠোনে রাখা বিধুচরণের মুখটা আড়াল থেকে শেষবারের মতো দেখতে বাড়ির পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছিল মেয়েরা।
বিকেল নাগাদ বাঁশের চাটাইতে শোয়া বিধুচরণের দেহটা নিয়ে শ্মশানযাত্রীরা যখন দাহের জন্য নদীর ধারে নিয়ে যাচ্ছিল তখনো বাণী একমনে নিশ্চল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বিধুচরণ চলে যাওয়ার পরে আজ সারাদিনে তার চোখে এক বিন্দু অশ্রুও আসেনি। হরিশের মা, কালীপদ আর ফটিকের বউ সারাক্ষণ পাশে বসে থাকলেও একটি কথাও বলেনি বাণী। একদিনের ব্যবধানেই বাড়িতে কত কী পাল্টে গেল। সন্ধ্যার পর সবাই একে একে বিদায় নেয়, বাণী তখনো একমনে অদৃষ্টের পানে চেয়ে থাকে।
রাত ফুরালেই রওনা হওয়ার পাকা কথা ছিল। কিন্তু বাণীর কথা ভেবে আর চারপাশের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে ভেবেচিন্তেই যাত্রার দিন একদিন পেছায় হিরণ। ওরা ওপারে পৌঁছালে তবেই রওনা দেবে কাউসার মিয়ারা – এমনটাই কথা ছিল। ব্যবস্থা পাকাপাকি হওয়ার পরে সপ্তাহ দেড়েক আগে বিধুচরণ নিজেই রঘুনাথ আর জব্বার গাড়োয়ানকে স্টেশনতক পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে বলে রেখেছিল। কিন্তু কে জানতো শেষমেশ বিধুচরণেরই যাওয়া হবে না। মহাদেবকে নিয়ে আগের রাতের মধ্যেই বাকি সবকিছুও গুছিয়ে নেয় সে। মালপত্র তোলার জন্য সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত আজিজও যেতে চেয়েছে।
এতদিন যাওয়ার জন্য নিত্য উথালপাতাল করা বাণী শেষদিন যাওয়ার আগে কেবল একনজরে সকল কিছু দেখে যায়। গত দেড়দিন যাবত হিরণ বহু চেষ্টা করেও বাণীর মুখে কিছুই তুলতে পারেনি। যখনই কিছু তুলতে যায় নিশ্চল হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বাণী। হিরণ আর কী বলবে। তবে হিরণ জানে, প্রথম প্রথম এমনই হবে, ওপারে যাওয়ার পর
আস্তে-ধীরে রয়েসয়ে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে।
দেড়দিন ধরে মালপত্র গুছিয়েও সারাটা সকাল মালপত্র গুছিয়ে যেন হিরণের শান্তি হয় না। বারবার সে মহাদেবকে তাড়া দেয় – কোনো কিছু বাদ পড়লো কি না। ঘরদোরের সমস্ত কিছু তুলে রসুইঘরেও তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ায় হিরণ। কয়েকটা নারিকেলের মালা কেবল পড়ে আছে। বেড়ার ধারে কয়েকটা কাগজ জমে আছে। রসুইঘর শেষে গোয়ালঘরে ঢোকে হিরণ। ওখানে আর কিইবা আছে। যাওয়ার দিন পাকাপাকি হওয়ার পরে দু-সপ্তাহ আগেই গাই আর বলদটা জলের দরে হাটে বিক্রি করে এসেছে বিধুচরণ। এখন হাটভর্তি গাই। কে আর কারটা কিনবে।
দ্বিপ্রহরেই রঘুনাথ আর জব্বার গাড়োয়ানের আসার কথা। তাই সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার সঙ্গে হাঁড়িতে ভাত আর তাওয়ায় বেগুন ফুটিয়ে রেখেছিল হিরণ। দূরের পথ বলে কথা, বের হওয়ার আগে খেয়ে নিলে পেটটা শান্তি থাকবে। এমন সময়ই ফটিকের বউ সদ্য ধোঁয়া উড়ানো কড়াই নিয়ে মহাদেবকে ডাকতে ডাকতে রসুইঘরে ঢোকে। হিরণ বেরিয়ে আসতেই ফটিকের বউ বলে, ‘আইজ চাইরডা শিঙ্গি মাছ দিয়ে কচু রানছি। যাওনের কালে তরা খাইয়া লইস। কোন সময় যাইবি খাইবি।’ বলেই বাণীর কাছে গিয়ে বসে। কিন্তু তাতেও বাণীর যেন কিছুই হয় না, সে আগের মতোই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। শিঙ্গি মাছের তরকারি দেখে সাতসকালে উঠে পান্তা খাওয়া হিরণের ক্ষুধাটা চাগাড় দিয়ে ওঠে।
দ্বিপ্রহরের আগেই রঘুনাথ আর জব্বার গাড়োয়ান এসে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। দু-চারটে আগেই মুখে দিয়ে নিয়েছিল হিরণ। মুখ পর্যন্ত তুলে দিয়ে বহু তদবিরের পরেও বাণীকে এক লোকমাও খাওয়াতে পারেনি সে। ততোক্ষণে দুই গাড়োয়ান, হিরণ, মহাদেব আর আজিজ মিলে সমস্ত কিছু তুলে নিয়েছে। দাওয়ায় বসা বাণীর কাছে ঘেঁষে হিরণ বলে, ‘আর দেরি করা যাইবো না মা। এবার উঠো। যাইতে হইবো।’ বাণী কোনো দ্বিরুক্তি না করে উঠে পড়ে। গরুর গাড়ির চাটাইতে পা দুটো তুলে দেয় বাণী।
অতঃপর দুদিন পরে প্রথমবারের মতো মুখ ফুটে বলে, ‘ও হিরণ, তর বাপরে যেইখানে পোড়াইছে ওই জায়গাখান আমারে একটু দেখবার দিবি বাপ।’
হিরণ বাণীর হাত দুটি পরম যতনে ধরে বলে ‘চলো।’ মায়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে গাঙের ধারে তুলাগাছটার কাছে বাপের দাহের জায়গাটা দেখিয়ে দেয়। ওখানটায় এসে একেবারে লেপটা মেরে বসে পড়ে বাণী। একমনে কী যেন দেখে যায়। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর হিরণ তাড়া দিয়ে বলে, ‘মা এবার চলো।’
কিন্তু কোনো রাগ করে না বাণী। হিরণ ফের তাড়া দেয়, ‘আর দেরি কইরো না মা। পরে কিন্তু গঙ্গারামপুর গিয়াও ট্রেন ধরা যাইবো না।’ কিন্তু তাতেও বাণীর যেন কোনো হুঁশ নেই। হিরণের মেজাজ খারাপ হয়। ট্রেন ফেল করলে শেষ। সে কড়া স্বরে ক্ষেপে গিয়ে এগিয়ে এসে বাণীর হাতটা টানে আর তখনই মাটিতে নিশ্চল হয়ে ঢলে পড়ে বাণীর নিস্তেজ দেহ।

