‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ এটি ১৯৫৮ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।
পটভূমি সূচনা-
‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসটি রচিত হয়েছে অতীশ দীপঙ্কর এবং তৎকালীন নালন্দা, রাজগীর এবং দাক্ষিনাত্যের পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর ওপর ভিত্তি করে। রাজা বিগ্রহপা্ল ও রাজকুমারী যৌবনাশ্রীর প্রেম কাহিনী পৃথ্বীরাজ চৌহান ও সুংযুক্তার ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে ভিত্তি করে। পিতা লক্ষীকর্ণ যৌবনাশ্রীর বিয়ের জন্যে স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করলেন এবং তাতে সমস্ত রাজাদের আহ্ববান জানায় ও রাজা বিগ্রহপাল আমন্ত্রিত হলেন না। বিগ্রহপাল রাজকন্যাকে হরণ করে আনতে চাইলেন ঠিক যেমন পৃথ্বীরাজ সংযুক্তা কে হরণ করেছিলেন।
ঠিক এই জায়গাটিতেই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আধুনিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় যখন রাজকুমারী বিগ্রহপালকে বলে, সে যেন সবার মাঝখান থেকে এসে স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত হয় এবং যৌবনাশ্রী তখন সেখানেই তাকে স্বামীরূপে বরণ করবে।
এখানে একটি কথা বলতেই হয়, অতীশ দীপঙ্কর এক ঐতিহাসিক চরিত্র হওয়া স্বত্বেও তিনি আধুনিক চিন্তাধারার ব্যক্তিত্ব হিসেবেই পরিচিত হয়েছেন। ইতিহাসের পাতার ধ্যানগম্ভীর ভাবমূর্তির অতীশ দীপঙ্কর লেখকের কলমের গুণে আধুনিকমনস্ক এক ব্যাক্তি হিসবে উপস্থিত হয়ে, বিগ্রহপাল ও রাজকুমারী যৌবনাশ্রীর বিবাহে রাজা লক্ষীকর্ণকে রাজী করানো এবং শেষকালে ওদের বিবাহ সম্পন্ন করে উপন্যাসটিকে মিলানাত্মক করে তোলা অত্যন্ত ভিন্নধর্মী ঔপন্যাসিকের পরিচয়।
‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসের আলোচনা-
উপন্যাসের কথা ঢের বলা হইয়াছে। উপন্যাসটির কথা বলিতে গিয়া আমিও কথার জাল বুনিয়া আরো একখানি উপন্যাস রচনা করিব, এমত নহে। তাহা হইলে কি কথা কহিব? উপন্যাসে বর্ণিত পুরাকালের কথা কহিব। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হইয়া হাজার বছর পূর্বেকার কথা কহিব। সে কাহিনি যেমনই রোমাঞ্চকর, তেমনই বিস্ময়কর। যুগ যুগ ধরিয়া সেই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়াছিল বলিয়াই ভারতবর্ষ জ্ঞানে, বিদ্যায় ও দর্শনের আলোকে শীর্ষ স্থান অধিকার করিয়া ছিল। কিন্তু উপন্যাস আলোচনাকালে সেইকালের কথা কেন? সে কাহিনি বলিতে গেলে কিঞ্চিৎ ইতিহাস জানা প্রয়োজন।
বহুযুগ আগে প্রায় হাজার বৎসর পূর্বে তখন ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের রমরমা চলিতেছে। বঙ্গদেশে তখন পাল বংশের রাজত্ব। পাল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ধর্মপালের রাজত্ব শেষ হইয়াছে বটে কিন্তু পালবংশের মহিমা তখনও অস্তমিত হয় নাই, সূর্য্য গগনে বিরাজমান। এমত সময়ে জন্মগ্রহণ করিলেন মহামতি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে তাঁহার জন্ম। পিতা কল্যানশ্রী ঐশ্বর্য্যে, সম্মানে স্থানীয় নৃপতি সমান ছিলেন, অর্থাৎ কিনা রাজার ঘরে জন্মগ্রহন করিয়াছিলেন অতীশ দীপঙ্কর। কিন্তু তথ্যে বুঝি কিছু ভুল হইল। জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন রাজা কল্যানশ্রীর পুত্র চন্দ্রগর্ভ। অতীশ দীপঙ্করের পূর্ব নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। মাতার নাম ছিল প্রভাবতী দেবী। কৈশোরে অধ্যয়ন কালে তৎকালীন বহু দিকপাল পন্ডিতগণের সাহচর্য্যে আসিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে অসঙ্গ, বসুবন্ধু, নাগার্জুন, চন্দ্রকীর্তি ইত্যাদি জ্ঞানী ও গুণী পন্ডিতদিগের নাম করা যায় যাঁহাদের নিকট চন্দ্রগর্ভ প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন।
যদিও পরবর্তী কালে মূল শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন সুবর্ণদ্বীপের বৌদ্ধপন্ডিত ধর্মকীর্তির নিকট। তিনিই ছিলেন প্রকৃত শিক্ষাগুরু। চন্দ্রগর্ভ বৌদ্ধতন্ত্রশাস্ত্রে বিশেষ পান্ডিত্য অর্জন করেন। সেই কারণে তাঁহার নাম হইয়াছিল গুহ্যজ্ঞানবজ্র। মাত্র ১৯ বৎসর বয়সে ওদন্তপুরী বিহারের মহাসংঘিক আচার্য্য নিযুক্ত হন। বুদ্ধমন্ত্রে দীক্ষিত হইবার পর নাম হইয়াছিল দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। বৌদ্ধ আচার্য্য শীলরক্ষিতের নিকট তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। বত্রিশ বৎসর বয়সে তৎকালীন সুবর্ণদ্বীপ, বর্তমান সুমাত্রা- যাভা দ্বীপে যাত্রা করেন। বার বৎসর তথায় অবস্থানকালে ধর্মকীর্তির নিকটে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন ও ভারতবর্ষে ফিরিয়া নানান বৌদ্ধবিহারে ধর্মচর্চা ও শিক্ষা দান করিতে থাকেন। বৌদ্ধশাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জনের পর মহারাজ ধর্মপাল প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশীলা মহাবিহারের মহাচার্য নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ধর্মচর্চা ও বৌদ্ধ শাস্ত্র শিক্ষা দানে তিনি প্রায় পনেরো বৎসর অতিবাহিত করিবার পর বিক্রমশীলা মহাবিহারের মহাচার্য থাকিবার সময়ে তিব্বত যাত্রা করেন।
এত সকল কথা জানিবার পর প্রশ্ন হইতে পারে একটি উপন্যাসের কাহিনি, মান ও গুণাগুণ আলোচনা কালে ইতিহাস, পুরাকালের কথা আলোচনা করিবার আবশ্যক কি? আবশ্যক আছে। উপন্যাসটি ভাল কি মন্দ, তাহার গুণাগুণ বিচার করিতে বসি নাই। উপন্যাসটি পাঠ করিয়া পাঠক কি লাভ করিলেন, কি লাভ করিতে পারেন তাহাই আলোচনা করিবার কথা ভাবিতেছি।
একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার কিছু সুবিধা ও অসুবিধা দুই ই আছে। সুবিধা হইল, এই ধরণের উপন্যাস রচনাকালে কাহিনির পটভূমিটি প্রস্তুত থাকে, শুধু লেখকের লিখিবার প্রস্তুতি ও ইচ্ছা প্রয়োজন। অসুবিধা হইল, গল্প কাহিনি বর্ণনায় এবং চরিত্রের কথোপকথনে লেখকের স্বাধীনতা থাকিলেও, ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করা যায় না। অতএব, গল্পের গরু গাছে উঠিতে পারে না। এক্ষণে উপন্যাসটিতে কাহিনির পাশাপাশি ঐতিহাসিক তথ্য কি কি রহিয়াছে তাহাই দেখা যাউক।
উপন্যাসটিতে শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকার প্রেম, বিরহ ও রোমান্সের কাহিনিই বর্ণিত হয় নাই। তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সম্বন্ধীয় তথ্য, বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের পাশাপাশি পালরাজাদের সমসাময়িক তান্ত্রিকতার প্রভাব, বিক্রমশীলা মহাবিহারের অবস্থান, চেদিরাজ্যের কলছুরি(নাকি কলচুরি?) বংশের নৃপতির সহিত পালবংশের রাজা নয়পালের যুদ্ধ এবং সর্বোপরি যুদ্ধে শান্তির মধ্যস্থতায় অতীশ দীপঙ্করের হস্তক্ষেপ, ততকালীন সময়ে ভারতে বিধর্মী শক্তির আগমনে অস্থিরতা ও অরাজকতার আশঙ্কায় দীপঙ্করের দুশ্চিন্তা এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য তিব্বত যাত্রা- এতগুলি ঐতিহাসিক উপকরণ লইয়াই উপন্যাসটি রচিত। উপন্যাসটি শুরু হইয়াছে অতীশ দীপঙ্করের তিব্বত যাত্রার প্রাক্কালে শুধু নয়, তিব্বত যাত্রার ঘটনা লইয়াই। যে যাত্রা পরবর্তীকালে তিব্বত, সিকিম এবং সমগ্র পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলির ধর্মের প্রকৃতি নির্ধারণের সহায়ক হইয়াছিল।
এতক্ষণে বোধকরি আলাপের পর উপন্যাসটির মূল কাহিনিতে প্রবেশ করা যাইতে পারে। কিন্তু তাহারও পূর্বে আমাদের জানা প্রয়োজন উপন্যাস রচয়িতা সম্বন্ধে দুই/চারিটি কথা।
‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ বাংলা সাহিত্যের একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস, রচয়িতার নাম শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতার নাম তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতার নাম বিজলীপ্রভা দেবী। জন্ম ১৮৯৯ সালের ৩০শে মার্চ, উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরে। শরদিন্দু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রথিতযশা ছোটগল্পকার এবং উপন্যাস রচয়িতা। বাংলা সাহিত্যে ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ নামক গোয়েন্দার সৃস্টি তাঁহারই কৃতিত্ব। শুধু গোয়েন্দা গল্প বা উপন্যাসই নহে, অলৌকিক ঘটনা ও ভুতের গল্প রচনাতেও তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু ছোটগল্প, গোয়েন্দা গল্প, ভুতের গল্প এই সব কিছু ব্যতিরেকে তাঁহার অসামান্য কৃতিত্ব হইল ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায়। ঐতিহাসিক রচনায় তাঁহার যাতায়াত ছিল ভারতের আর্য্যযুগ হইতে মৌর্য্য যুগ, মোগল হইতে স্বাধীনতা আন্দোলন-সর্বত্রই। এই সকল কিছুরই ইতিহাস তিনি অনায়াস দক্ষতায় পাঠ ও পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন, অসামান্য দক্ষতায় কাহিনির স্ফুরণ ঘটিয়াছে তাঁহার কলমে।
অতীশ দীপঙ্করকে আজ ভারতবাসী বিস্মৃত হইয়াছেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রে সুপন্ডিত তারানাথের রচনায় বিক্রমশীলা মহাবিহার এবং তৎপ্রসঙ্গে বিস্মৃত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের কথা প্রথম জনসমক্ষে আসে। অথচ ভারতে এমন কি সিকিম, তিব্বত, সুমাত্রা, যাভা প্রভৃতি স্থানে অতীশ দীপঙ্করই হইলেন বৌদ্ধতন্ত্রের মূল প্রতিষ্ঠাতা। ভারতবাসী তথা তাঁহার আপন বঙ্গদেশবাসীও তাহা মনে রাখে নাই।
বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পাল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ধর্মপাল। নালন্দা মহাবিহার তখনও থাকিলেও তাহার গরিমা ধীরে ধীরে স্তিমিত হইতেছিল। এমত সময়ে সোনাপুরী, ওদন্তপুরী, বিক্রমশীলা প্রভৃতি মহাবিহারগুলি বৌদ্ধশাস্ত্র ও অন্যান্য শাস্ত্র পঠন পাঠনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিক্রমশীলা মহাবিহার ছিল শীর্ষে। দর্শনবিদ্যা, ব্যকরণ, অধিবিদ্যা, ভারতীয় তর্কশাস্ত্রের পাশাপাশি তন্ত্রমহাবিদ্যারও পঠন ও পাঠন চলিত। এক কথায় সেই যুগে বিক্রমশীলা মহাবিহার ছিল তন্ত্রশাস্ত্রের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। উপন্যাসটিতে যে সময়ের কথা ব্যক্ত হইয়াছে, সেই সময় অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন সেই মহাবিহারের মহাচার্য।
একটি গৌরবময় লুপ্ত ইতিহাসকে লেখনীর মাধ্যমে পুনরায় জনমানসে ফিরাইয়া আনিবার কৃতিত্ব অবশ্যই লেখকের বা রচয়িতার। শুধুমাত্র সেই লুপ্ত ইতিহাসই নহে, বৌদ্ধযুগের এক অতি বিশিষ্ট বৌদ্ধপন্ডিতের জীবন, কর্মকান্ড এবং তৎকালীন বৌদ্ধসমাজের শ্রমণ ও সন্ন্যাসীদের সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি কর্তব্যের কথাও জানা যায় এই উপন্যাসটির মাধ্যমে। এককথায় আমাদের তাহা জানিতে উদ্বুদ্ধ করে। ইতিহাসের কোন কোন তথ্য আমরা এই উপন্যাসটির মাধ্যমে জানিতে পারি?
উপন্যাসটির শুরু হইয়াছে, তিব্বত হইতে আগত ভিক্ষুর সহিত অতীশ দীপঙ্করের সাক্ষাতের ঘটনাটির বিবরণে। দশম-একাদশ শতাব্দীতে অতীশ দীপঙ্কর যখন বিক্রমশীলা মহাবিহারের মহাচার্য ছিলেন, সেই সময় যে তিব্বতের রাজার নিকট হইতে দূত হিসাবে Nagtso নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু বিক্রমশীলা মহাবিহারে উপস্থিত হইয়াছিলেন, ইহা ঐতিহাসিক সত্য। যদিচ, দূতের নামকরণে উপন্যাস রচয়িতা নিজস্ব মত গ্রহণ করিয়াছেন। উপন্যাসটিতেও সেই সময়ের কথাই বলা হইয়াছে। তিব্বত হইতে দূতের মহাবিহারে আগমন এবং অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে যাবার আমন্ত্রণ ও অনুরোধ ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য। এমনকি কাহিনিতে বর্ণিত রত্নাকর শান্তি নামক চরিত্রটিও। রত্নাকর শান্তি ছিলেন বিক্রমশীলা মহাবিহারের মহাধ্যক্ষ। তিব্বতে সেই সময় ধর্মের নামে চলিতেছিল অরাজকতা। তিব্বতের রাজা বৌদ্ধধর্মকে রক্ষা করার অভিপ্রায়ে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে যাবার অনুরোধ করেন। ইতিহাসে জানা যায়, দীপঙ্কর প্রথমে এই অনুরোধ অস্বীকার করিলেও সুদীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়া তিব্বতে যাওয়াই মনস্থ করিয়াছিলেন। দীর্ঘ ত্রয়োদশ বৎসর তথায় বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা, রক্ষা করিয়া তিনি আর ভারতবর্ষে ফিরিতে পারেন নাই। বর্তমান চীন প্রদেশে তিনি দেহরক্ষা করেন।
উপন্যাসটিতে পালবংশের রাজা নয়পাল ও চেদিরাজ্যের কলছুরি(অন্যথায় কলচুরি) বংশের রাজা লক্ষ্মীকর্ণের বিবাদের কথা বলা হইয়াছে। রাজা নয়পাল ছিলেন পালবংশের রাজা মহীপালের পুত্র। বৌদ্ধযুগে যে ষোলটি মহাজনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়, চেদি রাজ্য ছিল তাহাদের অন্যতম। তাহাতে তখন রাজত্ব করিতেন কলছুরি বংশের রাজাগণ। কলছুরি’ নামের একটি ইতিহাস আছে। তাহারা নিজেদের মনে করিতেন পরশুরামের বংশধর। স্থানীয় ভাষায় ‘কল্লি’ শব্দের অর্থ গোঁফ’ এবং ‘ছুরি’ শব্দের অর্থ আমরা সকলেই জানি। ইহা তাঁহাদের প্রতীক ছিল। মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি কলছুরি বংশের ইহা টোটেম ছিল? দক্ষিণের যে অংশে চেদি রাজ্য অবস্থিত ছিল, সেই অঞ্চলে তখন কি অধিবাসীগণের ভিতর টোটেম রাখিবার নিয়ম ছিল- কিংবা টোটেম পূজার রীতি ছিল?
ইহা ঐতিহাসিক সত্য যে উত্তর কলছুরি বংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন গাঙ্গেয়দেব এবং তাঁহার পুত্র লক্ষ্মীকর্ণ ছিলেন সেই সময়ের একজন অত্যন্ত বীর। যদিও লক্ষ্মীকর্ণ নয়পালের নিকট পরাজিত হয়েন এবং তাঁহাদের মধ্যে সন্ধি হয়। আশ্চর্য্যের বিষয়, এই সন্ধি প্রস্তাব কার্য্যকরী হইয়াছিল অতীশ দীপঙ্করের মধ্যস্থতায়। ইহাও ঐতিহাসিক সত্য।
এক্ষণে একটি কথা বলা আবশ্যক মনে করি। সেকালের ধর্মীয় প্রধান, বৌদ্ধ পন্ডিত ও সংষ্কারক( বিশেষতঃ বৌদ্ধ যুগে) ইত্যাদি সকলে যেমন রাজনৈতিক আশ্রয় বা পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করিতেন, সেইরূপ রাজনৈতিক কারণে রাজাদের কখনও রাজনৈতিক, আবার কখনও বা কূটনৈতিক পরামর্শ দান করিতেন। হয়ত সেই কারণেই ইতিহাসেও এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন। বৌদ্ধধর্ম প্রচারে তাহাদের অবদান ছিল। সেই সময় বাংলায় সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধতন্ত্রবাদ একরকম আসন গাড়িয়া বসিয়া পড়িয়াছিল। এই উপন্যাসটিতেও তার আভাস পাওয়া যায়।
‘নয়পাল অনেকগুলি তান্ত্রিক সাধুকে লইয়া মাতিয়াছেন, দিবারাত্র গোপনে বীরাচারের অভ্যাস চলিতেছে’—উপন্যাসের পাতায় মহীপাল পুত্র নয়পাল সম্পর্কে যদি এই উক্তি করা হইয়া থাকে, প্রকৃতপক্ষে সমাজে তাহার প্রভাব পড়িয়াছিল অনেক বেশি। তিব্বতেও ধর্মসংকট দেখা দিয়াছিল বলিয়াই অতীশ দীপঙ্করের প্রয়োজন হইয়াছিল। কিন্তু ভারতবর্ষে তখন আর কেহ ছিল না, দীপঙ্করও তিব্বতে চলিয়া গেলেন, ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ধীরে ধীরে স্তিমিত হইয়া গেল। ভারতের পশ্চিম আকাশে তখন বিধর্মীদের আক্রমণ রুখিতে পারা যায় নাই। তারপরের ইতিহাস তো সকলেরই জানা আছে, দীর্ঘদিন ধরিয়া ভারতভূমি বিধর্মীদের পদানত হইয়া রহিল।
যদি উপন্যাসের অন্যান্য দিকগুলি লক্ষ্য করা যায়, তবে সেযুগের আবহাওয়ায় নারী-পুরুষের সাজপোষাকেরও একটা অংশ চোখে পড়িবে। নারীর সাজসজ্জ্বা লইয়া বিস্তর আলোচনা সর্বকালেই হইয়া থাকে, পুরুষদের সাজও নেহাত কম ছিল না।
‘তৎকালে স্ত্রী ও পুরুষের প্রসাধন অনেকটা একই প্রকার ছিল; বিলাসী পুরুষেরা অঙ্গদ কুন্ডল পরিতেন, লাক্ষারসে নখ ও অধর রঞ্জিত করিতেন, চোখে কাজল দিতেন। গলায় হার থাকিত, পায়ে ময়ূরপঙ্খী পাদুকা’। বৌদ্ধযুগের চিত্রকলায় পুরুষ ও নারীর সজ্জ্বার চিত্র আমরা নানান স্থানে পাইয়া থাকি। তাহারও অনেক পরে পালরাজাদের সময়েও সমাজের পুরুষেরা যে এইরূপ সাজসজ্জ্বা করিতেন তাহার একটি ছবি মিলিল।
ঐতিহাসিক উপন্যাসের আরো একটি বড় গুণ হইল, তাহার বাক্যবন্ধ ও শব্দ চয়ন। এই উপন্যাসটিতেও তাহার কমতি নাই। এমন কিছু শব্দের ব্যবহার আছে, যাহা আমরা সচরাচর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করি না, অনেক শব্দের অর্থও জানা নাই, কিন্তু তাহাতে দোষের কিছু নাই। সেই যুগের কিছু শব্দাবলীর সন্ধান এখানে পাওয়া যাইবে যাহার ব্যবহার ছিল অতি সাধারণ। কথোপকথনের একটি ধারা, রাজপরিবারগুলিতে মহিলামহলে ঠিক কি ধরণের কথাবার্তা চলিত তাহারও আভাস পাওয়া যায়। যদিও,এক্ষেত্রে লেখকের স্বাধীনতা পুরা মাত্রায় গৃহীত হইয়াছে। স্বাধীনতা কাহিনির বিন্যাসেও। রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতি নাই, কিন্তু কাহিনির বিন্যাস লেখকের নিজস্ব সৃষ্টি। ভাষার মাধুর্য্য এবং কাহিনির গতি উপন্যাস পাঠে আকর্ষণ জাগায়। অতীশ দীপঙ্করের মত এক মহান পন্ডিতের জীবন ও সমাজের প্রতি কর্তব্যকে নতুনরূপে জানার এবং জানাইবার মহৎ প্রয়াসকে অভিনন্দন জানাইতেই হইবে। উপন্যাসটি পড়িবার পর অতীশ দীপঙ্কর সম্বন্ধে কৌতুহল স্বাভাবিক।
উপন্যাসটির সার্থকতা এখানেই….. (সংগৃহীত)

