‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি কলকাতা ভিত্তিক গৌতম ঘোষ পরিচালিত ভারতীয় চলচ্চিত্র। এটি কমলকুমার মজুমদারের মহাযাত্রা নামে একটি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। চলচ্চিত্রটি উনিশ শতকের বাংলার কুলীন ব্রাহ্মণদের বহু বিবাহের একটি দলিল। ছবিটি ১৯৮৮ সালে বাংলাতে সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল। এটি ১৯৮৮ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে সুনিশ্চিত সম্মান বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যে নিরীক্ষাধর্মী লেখকদের মধ্যে অন্যতম নাম কমলকুমার মজুমদার। ছোটগল্প এবং উপন্যাস রচনায় তিনি এক স্বতন্ত্র স্বর প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সাহিত্যকর্ম জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা না করেও নিজস্ব ভাষাশৈলী এবং ব্যতিক্রমী আঙ্গিকের কারণে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
তার রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস। প্রথমবার এটি একটি অল্প পরিচিত পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
কাহিনি ও প্রেক্ষাপট-
‘অন্তর্জলী যাত্রা’ মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর এক ভয়াবহ সামাজিক প্রথা- সতীদাহের পটভূমিতে রচিত। উপন্যাসের মূল চরিত্র যশোবতী, যাকে স্বামীর মৃত্যুর পর সামাজিক বিধি-নিষেধ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের নামে জীবন্ত সতী হতে বাধ্য করা হয়। সমাজপতি, কুলপুরোহিত এবং পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের নিষ্ঠুর ও নির্মম চক্রান্ত এই উপন্যাসে উন্মোচিত হয়েছে। অনন্তহরি, কৃষ্ণপ্রাণ এবং লক্ষ্মীনারায়ণের মতো চরিত্ররা কীভাবে যশোবতীর ভাগ্য নির্ধারণ করে, তা লেখক অত্যন্ত শৈল্পিক দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
ভাষাশৈলী ও লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি-
কমলকুমার মজুমদারের গদ্যশৈলী স্বতন্ত্র এবং ব্যতিক্রমী। তার ভাষা কখনও কবিতার মতো, কখনওবা কঠোর বাস্তবতার নির্মম প্রতিবিম্ব। তিনি এই উপন্যাসে শ্মশানঘাটের ভৌতিক পরিবেশ, সমাজের গোঁড়ামি এবং নারীর প্রতি সহিংস দৃষ্টিভঙ্গিকে এমনভাবে চিত্রিত করেছেন, যা পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘এই গ্রন্থের ভাববিগ্রহ রামকৃষ্ণের, ইহার কাব্যবিগ্রহ রামপ্রসাদের।’ অর্থাৎ এটি শুধুমাত্র এক সামাজিক বাস্তবতার উপস্থাপন নয় বরং মানবজীবনের গভীরতম সত্যকেও আবিষ্কারের প্রচেষ্টা।
পরিশেষে বলা যায়-
‘অন্তর্জলী যাত্রা’ শুধু সতীদাহের মতো বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে এক সাহিত্যমূলক প্রতিবাদ নয়, এটি এক দার্শনিক বিশ্লেষণও বটে। অল্প পরিসরের এই উপন্যাস পাঠকের মনের গভীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। বাংলা সাহিত্যে কমলকুমার মজুমদারের অবদান অনস্বীকার্য এবং তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

