কলকাতা, ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯: কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে এক জাঁকজমকপূর্ণ জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত এলবার্ট হলে (বর্তমান কফি হাউস) আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন ‘কল্লোল’ পত্রিকার সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ ও ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, যাঁরা সংবর্ধনা সমিতির যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ ও হবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন এস. ওয়াজেদ আলী এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
দুপুর দুটোয় ফুল দিয়ে সুসজ্জিত মোটরগাড়িতে করে নজরুলকে অনুষ্ঠানে আনা হয়। তিনি সভাকক্ষে প্রবেশ করলে সবাই উল্লাসধ্বনি দিয়ে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। শিল্পী উমাপদ ভট্টাচার্য উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে পরিবেশন করেন নজরুলের রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি। এরপর এস. ওয়াজেদ আলী সংবর্ধনা কমিটির পক্ষ থেকে কবিকে অভিনন্দন পত্র পাঠ করে শোনান, যা পরে একটি রূপার কাসকেটে সংরক্ষিত করে সোনার দোয়াত ও কলমসহ কবির হাতে তুলে দেওয়া হয়।
সভায় রায় বাহাদুর জলধর সেন নজরুলের সাহিত্যিক অবদানের প্রশংসা করে বক্তব্য রাখেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা নজরুলের গান গেয়ে এগিয়ে যাব, কারাগারেও তাঁর গান আমাদের সঙ্গী হবে।”
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন, “আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সত্যিকারের মৌলিক প্রতিভা আমরা পেয়েছি মাত্র দু’জন কবির মধ্যে- একজন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অপরজন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের কবিতায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য বার্তা রয়েছে। তিনি শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি সমগ্র বাংলার কবি।”
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন অপূর্বকুমার চন্দ, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্রসহ বহু সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক নেতা। সংবর্ধনার একপর্যায়ে নজরুল তাঁর জনপ্রিয় গান ‘টলমল টলমল পদভরে বীরদল চলে সমরে’ পরিবেশন করেন। নেতাজির অনুরোধে তিনি আরও একটি বিখ্যাত গান ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গেয়ে শোনান।
অনুষ্ঠানের শেষে নজরুল অভিভূত কণ্ঠে বলেন, “আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার তনু-মন-প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে। আমি ধন্য হলুম।”
এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান নজরুলের প্রতি জাতীয় সম্মান ও ভালোবাসার এক অবিস্মরণীয় উদাহরণ হয়ে রয়ে গেল।

