ভাবুন– একজন নারী, নাম দিলেন পুষ্প। খুব অল্প বয়সে পুষ্প’র বিয়ে হল, মেয়েটির বয়স যখন ১৫ বছর- ঠিক সেই সময়ে ৪০ বছর বয়সী তার স্বামী মারা গেল। তখন স্বামীর মৃত্যুতে শোকাহত অবস্থায় শ্মশান পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হল ‘পুষ্প’কে। স্বামীর শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের নামে তাকে প্রায় শ্মশানে সহমরণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এতটাই অল্প বয়সে বিধবা হয়ে তাকে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। চিতায় সাজিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় মৃত স্বামীর সাথে পুষ্পকেও। ভ্রান্ত ধারণা দেওয়া হয়, স্বামীর চিতায় স্ত্রীকেও পুড়িয়ে দিলে উভয়ে স্বর্গবাসী হবে! তবে ভাবুন, পুষ্প’র সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যে কোনও সাধারণ নারীর জন্য অত্যন্ত ‘দুঃসহ’ হবে- তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এমন বহু পুষ্প আগুনের শিখায় নিজেকে বিলীন করেছেন। এসব পরিণতির যন্ত্রণার কথা জানিয়ে সমাজে এক ভিন্ন চিত্র ফুটে ওঠে। তবে এটি কোনও কল্পকাহিনী নয়; প্রকৃতপক্ষে এই প্রথার শিকার হয়েছিল হাজার হাজার নিরপরাধ নারী।
এই প্রথার উৎপত্তি হয়েছিল ‘সতী নামক এক দেবী’ থেকে। যিনি স্বামীর মৃত্যুর পর তার সাথে সহমরণের জন্য শ্মশানে প্রবেশ করেছিলেন। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে সতীদাহ বা সহগমন প্রথা একসময় অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতে নারীকে তার স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বামীর সঙ্গে চিতায় আগুনে পুড়তে বাধ্য করা হতো, যা পরবর্তী জন্মে তার সম্মান বৃদ্ধির আশায় করা হতো।
বেদের কোনও নির্দেশে সতীদাহের কথা বলা হয়নি, তবে সনাতন ধর্মের পুরাণে কিছু চরিত্র রয়েছে যারা স্বামীর মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন। তথাপি, পরবর্তীতে ‘সতীদাহ’ নামে পরিচিত এই প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় এবং লক্ষ লক্ষ নারীর জীবন কেড়ে নেয়।
এই প্রথার বিরোধিতার জন্য ১৮শ শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কারক আন্দোলন গড়ে তোলেন। রামমোহন রায় এবং উইলিয়াম কেরির মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তারা সরকারের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান। ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতীয় উপমহাদেশে সতীদাহ নিষিদ্ধ করেন। তবে, সমাজের অনেক প্রান্তে এই প্রথা এখনও চালু ছিল, যা সামাজিক নিন্দার মুখে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এমন একটি ভয়ানক প্রথা সমাজ থেকে পুরোপুরি অপসারিত হতে সময় লেগেছিল, তবে জনসচেতনতার বৃদ্ধি ও আইনগত পদক্ষেপের কারণে ভারতের এই নিষ্ঠুর প্রথা অবশেষে বিলুপ্ত হয়।
লেখক- এফ.আর. ইমরান; সাংবাদিক- ‘সিটিজেনস ভয়েস’

