হুমায়ুন কবীরের ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসের কথা মনে আছে? যেখানে নদীর চরের মানুষের জীবনালেখ্য আঁকা হয়েছে। কিংবা কবি প্রতীপ চন্দ্র বসুর ‘ভালোবাসা নদী’? যেখানে তিনি নদীর স্রোতের মাঝে খুঁজে পেয়েছেন প্রিয়জনের মুখচ্ছবি। মহাকবি কালিদাসও তাঁর সাহিত্যকর্মে নদীকে এক রমণীরূপে ব্যাখ্যা করেছেন।
এসব সাহিত্যকর্ম থেকে সহজেই বোঝা যায়, নদী ও নারীর মধ্যে এক গভীর আত্মীয়তা রয়েছে। তারা প্রকৃতিগতভাবেই সম্পৃক্ত, একে অপরের সঙ্গে অদৃশ্য এক বন্ধনে আবদ্ধ।
এই ভাবনাটি হঠাৎ করেই আমার মনে এলো, যখন আমার বোনের বিয়ে হলো। আগে কখনও এভাবে ভাবিনি। নদী যেমন নিরন্তর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়- নারীও তেমনই এক সংসার থেকে অন্য সংসারে গমন করেন। এই যাত্রা তার জন্য নতুন জীবনের সূচনা হলেও- এর গভীরে লুকিয়ে থাকে আবেগ, বেদনা ও স্মৃতির স্রোত।
আমাদের সংস্কৃতিতে বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে নদীর রয়েছে এক বিশেষ সম্পর্ক। এয়োতুলিরা- যারা বিয়ের আচার সম্পন্ন করেন- তারা প্রতিবার নদীর কাছে যান এবং তারা সকলেই নারী। ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রতিটি নদীকেই গঙ্গারূপে কল্পনা করা হয় এবং নদীকে পুজো করে বিয়ের নিমন্ত্রণ জানানো হয়।
এই রীতি যেন প্রকৃতির সঙ্গে এক আত্মিক সংযোগের প্রতিচিত্র। নারী যেমন নতুন জীবনধারার বাহক, নদীও তেমনি প্রাণের উৎস- উর্বরতার প্রতীক। এটি এক অপূর্ব সহাবস্থান, প্রাণময়তা ও প্রাণপ্রাচুর্যের এক অসাধারণ সংমিশ্রণ।
নারীর বিবাহকালীন কান্না- যা কখনও প্রকাশিত, কখনও অপ্রকাশিত। তাকে কি নদীর ব্যথার সঙ্গে তুলনা করা যায় না? আমরা যেমন প্রতিনিয়ত নদীকে দূষিত করছি, তেমনি সমাজ নারীকেও একাধিকভাবে অবমানিত করছে। নদীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার বুকে আমরা বর্জ্য ফেলছি, তাকে কলুষিত করছি- এ যেন এক নির্মম ধর্ষণেরই রূপক।
একইভাবে, নারীও সমাজের নানা নিপীড়নের শিকার। কিন্তু যদি নারী তার যথাযথ মর্যাদা পায়, যদি নদীর শুদ্ধতা রক্ষা করা হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ এক নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাবে।
কিন্তু বর্তমান? নারী ও নদী- উভয়ের পথই আজ কণ্টকময়। আমাদের দায়িত্ব হলো এই কণ্টকময় পথ দূর করে তাদের জন্য এক কোমল, স্নিগ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা। যেখানে নদী হবে প্রবাহমান, নির্মল, প্রাণবন্ত, আর নারী হবে মর্যাদাসম্পন্ন, স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল। এই কল্যাণকর ভবিষ্যৎই আমাদের সমাজ ও পরিবেশের জন্য এক সত্যিকারের মঙ্গলবার্তা বয়ে আনবে।

