রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অশেষ বরকত ও রহমতের মাস। প্রত্যেক মুসলমান এই পবিত্র মাসের ফজিলত লাভ করতে চায় এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য সাধ্যানুসারে ইবাদতে মশগুল থাকে। তবে সাধারণ কিছু ভুল এই মহিমান্বিত মাসের যথার্থতা নষ্ট করতে পারে। নিচে তেমন কয়েকটি ভুল ও তা পরিহারের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. রোজার বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতা
রোজা পালন করতে হলে তার বিধান ও নিয়ম সম্পর্কে জানা আবশ্যক। ইসলামি শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী, ফরজ ইবাদত পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। অনেকেই রোজার নিয়ত, সাহরি ও ইফতারের সঠিক নিয়ম, রোজা ভঙ্গের কারণ এবং নফল ইবাদত সম্পর্কে জানেন না। ফলে তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল করে ফেলেন। তাই রোজার বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা জরুরি।
২. রোজা রেখেও পাপাচারে লিপ্ত থাকা
রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো সংযম ও আত্মশুদ্ধি। কিন্তু অনেকে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকলেও মিথ্যা বলা, গীবত করা, গালমন্দ করা, পরনিন্দা ও বেপর্দা চলাফেরার মতো গুনাহ থেকে বিরত থাকেন না। মহানবী (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মন্দ কথা ও মন্দ কাজ ত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৮০৪)
৩. কিছু সুন্নত পালন না করা
রমজান মাসে কিছু সুন্নত পরিত্যাগ করা হয়, যা অনুচিত। যেমন মিসওয়াক করা। মহানবী (সা.) বলেছেন, “আমি যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর মনে না করতাম, তবে প্রত্যেক নামাজের সময় মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৮৭)
এছাড়া রোজার সময় কেউ কেউ পেটে পানি যাওয়ার ভয়ে কুলি ও নাকে পানি দেওয়া এড়িয়ে চলেন, যা ভুল ধারণা। কেবল গড়গড়া ও নাকে গভীরভাবে পানি টেনে নেওয়া নিষেধ করা হয়েছে।
৪. আজানের পরেও খাওয়া
অনেকে মনে করেন, সাহরির সময় শেষ হওয়ার পরেও কিছু খাওয়া যায়, যা একটি মারাত্মক ভুল ধারণা। আজান শুরু হওয়ার পর পানাহার করা রোজা ভঙ্গের কারণ হতে পারে। মহানবী (সা.) বলেন, “যতক্ষণ না ইবনে উম্মে মাকতুমের আজান শোনো, ততক্ষণ তোমরা খাও ও পান করো। কেননা সে ফজর উদিত না হলে আজান দেয় না।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯১৯)
৫. ইবাদতে অমনোযোগী থাকা
রমজান ইবাদতের বসন্তকাল, কিন্তু অনেকেই অলসতার কারণে নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতে মনোযোগী হন না। অথচ আল্লাহ বলেন, “তারা নামাজ নষ্ট করল এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করল, ফলে তারা শাস্তি ভোগ করবে।” (সুরা মারিয়াম, আয়াত: ৫৯)
৬. ইবাদতের ধারাবাহিকতা রক্ষা না করা
অনেকেই রমজানের শুরুতে নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াত শুরু করলেও পরে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো যে আমল ধারাবাহিকভাবে করা হয়, যদিও তা অল্প হয়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭৮৩)
৭. রমজান মাসে বিয়ে না করা বা স্বামী-স্ত্রী পৃথক থাকা
অনেকে মনে করেন, রমজান মাসে বিয়ে করা অনুচিত বা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে পারবে না। অথচ ইসলামি শরিয়তে এর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। মহান আল্লাহ বলেন, “রোজার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭)
৮. পানাহারে অপচয় করা
রমজানে সংযমের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অনেকেই অতিরিক্ত ও অপচয়মূলক খাবার খেয়ে ফেলেন, যা ইসলাম পরিপন্থী। আল্লাহ বলেন, “তোমরা খাও এবং পান করো, তবে অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।” (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)
৯. ইফতার ও সাহরিতে দোয়া না করা
ইফতার ও সাহরির সময় দোয়া কবুলের বিশেষ মুহূর্ত। অথচ অনেকেই এই সময় পার্থিব আলোচনায় মগ্ন থাকেন। মহানবী (সা.) বলেন, “তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না— রোজাদারের ইফতারের সময়, ন্যায়বান শাসকের দোয়া এবং মজলুমের দোয়া।” (তিরমিজি, হাদিস: ২৫২৬)
১০. শেষ দশকে কেনাকাটায় মগ্ন থাকা
রমজানের শেষ দশক ইবাদতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেকেই এই সময়টিতে বাজারে কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন, ফলে ইবাদত থেকে বঞ্চিত হন। মহানবী (সা.) শেষ দশকে ইবাদতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) শেষ দশকে যে পরিমাণ মুজাহাদা করতেন, অন্য সময় তা করতেন না।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৭৫)

