বাংলাদেশে রোজা এবং রমজান মাস বাঙালি মুসলমানদের জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সাহ্রি, ইফতার ও এক মাসের সংযম সাধনার মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবন এক নতুন রূপ পায়। ইসলামে রোজা ফরজ হিসেবে হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে প্রবর্তিত হওয়ার পর, এটি বিশ্বের মুসলিমদের মধ্যে এক অপরিহার্য ধর্মীয় অনুশাসনে পরিণত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সাহিত্যিকরা নানা স্মৃতিকথায় রমজান মাসের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব তুলে ধরেছেন। একসময় রমজান ছিল নির্ধারিত নিয়মে পালিত, তবে উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে রোজা পালন নিয়ে সচেতনতা কম ছিল। কবি আবুল মনসুর আহমেদ তাঁর আত্মজীবনী ‘আত্মকথায়’ লিখেছেন, পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ অঞ্চলে উনিশ শতকের শেষ দশকে মসজিদ ছিল না, এমনকি অনেক বয়স্ক ব্যক্তি দিনের বেলা পানি ও তামাক খেতেন, তবে রোজা রাখতেন। তবে বিশ শতকের শুরু থেকে ধর্মীয় সচেতনতার বৃদ্ধির সঙ্গে রোজা পালন ও রমজানের সত্যিকারের গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঈদ’ প্রবন্ধে রোজা পালন ও ঈদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কলিকাতা থেকে রোজার চাঁদ ও ঈদের খবর প্রচার হতো, যার ফলে ভারতীয় মুসলমানরা একই দিনে রোজা পালন করতেন।’ তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, মুসলমানদের মধ্যে ধৈর্য, সহ্য ও সংযমের বার্তা পৌঁছাত এবং রোজার দিনে বিড়ি বা চা পান না করার সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখত।
কবি শামসুর রাহমান তাঁর আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয়’ লেখাতে লিখেছেন, তাঁর নানা মুন্সি আফতাব উদ্দিন আহমদ রোজা কখনও বাদ দেননি এবং পবিত্র মাসে নামাজ ও কোরআন পাঠ করতেন। এর মাধ্যমে রোজা শুধু একটি ধর্মীয় কাজ নয় বরং নৈতিক শৃঙ্খলা ও আত্মিক উন্নতির অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
রোজা রাখার বিষয়ে শিশুদের মধ্যে এক বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়। কবি সুফিয়া কামাল তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন, প্রথম রোজা রাখলে সেটি একটি আনন্দ উৎসব হয়ে উঠত। তিনি তাঁর শৈশবের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লিখেছেন, কিভাবে পরিবারের সদস্যরা ছোটদের উৎসাহিত করতেন এবং তাদের রোজা রাখার আনন্দকে বিশেষভাবে উদযাপন করতেন।
আনিসুজ্জামানও তাঁর আত্মজীবনী ‘কাল নিরবধি’ রমজানের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। যেখানে তিনি বলেন, ছেলেবেলায় রোজা রাখতে চাইলে নানা রকম নিরুৎসাহিত করা হতো, তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ছোট ছোট রোজা রাখতে শুরু করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতাগুলি রমজানের প্রতি তাদের বিশেষ ভালোবাসা এবং চিরন্তন শৃঙ্খলার প্রতীক।
রোজার মাসে ইফতারের সময় পুরো মুসলিম সমাজে এক ঐক্যবোধের সৃষ্টি হয়। যা সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বর্দুর মতে, এ ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা সামাজিক মূলধনের উৎস। যা মানুষকে একে অপরের বিপদে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করে।
তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে রমজানের সময় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে জনগণের অসন্তোষও সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে একাধিক পোস্টে এসব অসংযমের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হচ্ছে। যা প্রমাণ করে যে, ধর্মীয় কার্যক্রমে কিছু সীমাবদ্ধতা এবং অসংযমের দিকে ইঙ্গিত করে।
যদিও কিছু মানুষ রোজার মাসে সংযমের মাঝে ব্যতিক্রমী আচরণ দেখান, তথাপি রমজান প্রতিবারই বাঙালি সমাজে আত্মশুদ্ধির সুযোগ এনে দেয়- যা সমাজের সব স্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

