সাহিত্যকে শুধুমাত্র অলংকার ও শব্দচিত্রে সীমাবদ্ধ করে দেখার প্রবণতা বহু পুরোনো। তবে সাহিত্যের প্রকৃত রূপ শুধু শব্দের জোগাড়গোছ নয়; এর গভীরে লুকিয়ে থাকে একটি তীব্র ভাবগত ও দার্শনিক বিস্তার। সাহিত্যের শক্তি তার বক্তব্য ও উপস্থাপনের অনন্য সমন্বয়ে- যেখানে একদিকে নান্দনিকতা, অন্যদিকে থাকে গভীর জীবনচিন্তা। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কই সাহিত্যকে করে তোলে পুনঃপাঠযোগ্য, বারবার নতুনভাবে উপলব্ধিযোগ্য।
ভালো সাহিত্য সেই, যেটি প্রতিবার পাঠে ভিন্ন অর্থ ও অভিজ্ঞতা এনে দেয়। পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যও নতুন হয়ে ধরা দেয়। এর পেছনে রয়েছে সাহিত্যের অন্তর্নিহিত রহস্যময়তা ও গভীরতা। যা সম্পূর্ণভাবে ধরা দেয় না একক পাঠে। আর এখানেই সাহিত্য দর্শনের সঙ্গে মিলে যায়। কারণ সাহিত্য শুধু অনুভবের বিষয় নয় বরং এক গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষণও বটে।
সাহিত্য ও দর্শনের এই মেলবন্ধন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’র প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে চলে আসে। ১৯১৩ সালে যখন পৃথিবী ধাবমান এক ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে, ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ বিশ্ববাসীর কাছে এক আধ্যাত্মিক আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। ইউরোপীয় বাস্তবতাবাদ ও যুক্তিনির্ভর সাহিত্যধারার বাইরে দাঁড়িয়ে ‘গীতাঞ্জলি’ উপহার দেয় এক অন্যধারার অভিজ্ঞতা, যেখানে সৌন্দর্য, আত্মিকতা ও দর্শন মিলেমিশে যায়।
রবীন্দ্রনাথ তার এ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ নিজেই করেন। আর এ অনুবাদ কেবল শব্দান্তরের কাজ নয় বরং তা এক নতুন সৃষ্টিকর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়। উপনিষদের ভাবধারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মানুষ ও ঈশ্বরের সম্পর্ককে যে আধ্যাত্মিক ভাষায় তুলে ধরেন- তা পাশ্চাত্যের পাঠকদের কাছে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ‘গীতাঞ্জলি’র নান্দনিকতা তাদের মোহিত করলেও- মূল আকর্ষণ ছিল এর অন্তর্নিহিত দর্শন ও জীবনদর্শন।
তবে রবীন্দ্রনাথকে কেবল ভাববাদী আখ্যায় সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। বরং তিনি ছিলেন এক বাস্তববাদী মনীষী, যিনি রাষ্ট্র, কৃষি, শিক্ষা ও বিজ্ঞানসহ সমাজের নানাদিক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি নিজের ভেঙে পড়া বিশ্বাসের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন পূর্ব থেকে এক নবদিগন্তের আগমনে- যা সমাজ ও সভ্যতার পথপ্রদর্শক হবে।
রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয় তার ‘গোরা’ উপন্যাসেও। উপন্যাসটি যেন এক আধুনিক মহাকাব্য, যেখানে ভারতবর্ষের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা রয়েছে এক বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক অন্বেষণের মাধ্যমে। এখানেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে- দর্শনের অনুপস্থিতিতে সাহিত্য সম্পূর্ণ নয়।
সাহিত্য হৃদয় ও মস্তিষ্কের সম্মিলিত একটি শিল্প। আনন্দ প্রদান এর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলেও- সেই আনন্দ হতে হয় অনুভব ও বুদ্ধির মিলনস্থলে সৃষ্ট এক বিশেষ অনুভব। আর এই দ্বন্দ্ব- হৃদয় ও বুদ্ধির, উপস্থাপন ও বক্তব্যের- এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কেই সাহিত্য হয়ে ওঠে জীবন্ত, বহুমাত্রিক ও চিন্তার খোরাক।
সার্বিকভাবে বলা যায়, সাহিত্য ও দর্শন একে অপরের পরিপূরক। মহৎ সাহিত্য কখনোই দার্শনিক চিন্তা ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাই সাহিত্য নিয়ে যে কোনো আলোচনা, যে কোনো বিশ্লেষণেই দর্শনের উপস্থিতি অপরিহার্য। কারণ সাহিত্য- তার গভীরতায়, মানবিকতায়, চিন্তায় এবং শেষ পর্যন্ত একটি দার্শনিক অন্বেষণ।
- লেখক- এফ.আর. ইমরান; সাংবাদিক- ‘সিটিজেনস ভয়েস’

