সাহিত্য ও সমাজের সম্পর্ক সুপ্রাচীন ও গভীর। সমাজের প্রতিফলন যেমন সাহিত্যে ঘটে, তেমনি সাহিত্যও সমাজের কাঠামো ও দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। সময়ের পরিবর্তনে সাহিত্যের ভাষা, রূপ ও রীতি বদলালেও সমাজের বাস্তবতা ও মানবিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ থেকে সাহিত্য কখনো বিচ্ছিন্ন হয়নি। সমাজে সাম্য, মৈত্রী ও মিলনের সেতুবন্ধ তৈরিতে সাহিত্যের ভূমিকা বরাবরই প্রাসঙ্গিক ও প্রভাবশালী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাহিত্য সমাজের অনুগামী হলেও তা শুধু অনুসরণেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং সমাজের অসংগতি, সংকট ও সম্ভাবনাকে তুলে ধরে সাহিত্যের আয়নায় সমাজ বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ পায়। সাহিত্যিক সমাজেরই একজন প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর রচনায় তুলে ধরেন যুগধর্ম, পরিবেশ ও মানসিকতার প্রতিফলন। ফলে সাহিত্য হয়ে ওঠে সময়ের দলিল ও বিবর্তনের সঙ্কেতবাহী ক্যানভাস।
বিশ্বসাহিত্যে বহু সাহিত্যিক তাঁদের রচনায় সমাজের নানা স্তরের চিত্র উপস্থাপন করেছেন। লিও টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা, দস্তয়ভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, পার্ল এস. বাকের দ্য গুড আর্থ, শেক্সপিয়রের নাটকসমূহ কিংবা ম্যাক্সিম গোর্কির মা- প্রতিটি সাহিত্যকর্মই সংশ্লিষ্ট সমাজের ন্যায়-অন্যায়, প্রেম-ঘৃণা, সংকট-সমাধানের প্রতীকী উপস্থাপনা। এসব রচনায় ব্যক্তি থেকে বৃহত্তর সমাজ কাঠামো অব্দি চিত্রিত হয়েছে নিখুঁত বাস্তবতার ছোঁয়ায়।
বাংলা সাহিত্যেও সমাজচিত্র বরাবরই গুরুত্ব পেয়েছে। সাহিত্যিকদের রচনায় গ্রামীণ সংস্কৃতি, শহুরে জটিলতা, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, প্রেম-সংসার ও শ্রেণি-বৈষম্যের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। চর্যাপদ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, কিংবা জসীমউদ্দীনের ‘নকশিকাঁথার মাঠ’- প্রতিটি সৃষ্টিতেই সমাজের নির্যাস ফুটে উঠেছে।
চর্যাপদের নিগূঢ় ভাব ও প্রতীকের আড়ালেও অনুন্নত শ্রেণিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার বাস্তবতা প্রকাশিত। মধ্যযুগীয় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ও ‘মঙ্গলকাব্য’ সমাজে নারীর অবস্থান, কুসংস্কার ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আধুনিক যুগে বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন, দীনবন্ধু মিত্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, মানিকসহ অনেক সাহিত্যিকের সৃষ্টিকর্মে সমাজের রূপান্তরের ধারা ও বাস্তবতা সুস্পষ্ট।
নাট্যসাহিত্যেও সমাজচিত্র অঙ্কিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের প্রতীকী নাটকগুলোয় সমাজের চাওয়া-পাওয়া ও সংকটের চিত্র দেখা যায়। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ ও ‘সধবার একাদশী’ নাটকে ঔপনিবেশিক শোষণ ও শিক্ষিত সমাজের অবক্ষয় তুলে ধরা হয়েছে।
কবিতায়ও এই প্রবণতা অনস্বীকার্য। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী চেতনা, সুকান্ত ভট্টাচার্যের সমাজমনস্কতা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা জসীমউদ্দীনের গ্রামীণ জীবনের আবেগ- সবকিছুই সাহিত্যকে সমাজের দর্পণে পরিণত করেছে।
সমাজ ও সাহিত্যের এই পারস্পরিক সম্পর্ক কেবল ঐতিহাসিক নয়, এটি সময়োপযোগীও। সাহিত্য যেমন সমাজ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে, তেমনি সমাজও সাহিত্যের আলোয় নিজের পথ খুঁজে পায়। সাহিত্য শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং এটি একটি নান্দনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রাপথ- যেখানে সমাজের ভেতরের রূপ, দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তনের ছবি নিরন্তর আঁকা হয়।
তাই সাহিত্যিকের দায়িত্ব কেবল সৃষ্টিকর্মে সীমাবদ্ধ নয়, তাঁর উচিত সমাজের কল্যাণে সাহিত্যের মাধ্যমে দিশা দেখানো। সাহিত্যের মধ্য দিয়েই প্রজন্মান্তরে সমাজের চেতনাপ্রবাহ প্রবাহিত হয়- গড়ে ওঠে মানবিকতা ও সংস্কৃতির শেকড়।

