“আন্না কারেনিনা” উপন্যাসটি রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয় রচনা শুরু করেন ১৮৭৩ সালে এবং এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে। এই উপন্যাসটি প্রথমে সিরিয়াল আকারে “Russian Messenger” নামে একটি সাহিত্যপত্রিকায় ১৮৭৫ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। পরে একই বছর তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
সংক্ষিপ্ত কাহিনি:
“সব সুখী পরিবার একরকম সুখী, কিন্তু সব অসুখী পরিবার আলাদা আলাদাভাবে অসুখী।”– এই বিখ্যাত বাক্য দিয়েই শুরু হয় রুশ সাহিত্যের এই অনন্য সৃষ্টি। “আন্না কারেনিনা” কেবল এক নারীর প্রেমগাথা নয়, এটি একাধারে সমাজ, বিবাহ, নৈতিকতা ও আত্মপরিচয়ের গভীর অনুসন্ধান।
আন্না ও তাঁর পারিবারিক জীবন-
আন্না কারেনিনা একজন রাশিয়ান অভিজাত নারী। তিনি রুশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অ্যলেক্সেই আলেকসান্দ্রোভিচ কারেনিনের স্ত্রী। তাদের সংসার রয়েছে- আছে একটি পুত্রও। আন্না মূলত এক দায়িত্বপরায়ণ স্ত্রী ও মা হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু এই সম্পর্কের মাঝে আবেগ, উষ্ণতা ও প্রাণচাঞ্চল্যের অভাব তাকে এক অন্তঃসারশূন্য জীবনের দিকে ঠেলে দেয়।
নিষিদ্ধ প্রেমের সূচনা-
আন্নার ভাই স্তেপান ওবলনস্কির দাম্পত্য কলহ মীমাংসা করতে গিয়ে আন্না মস্কোতে আসেন এবং সেখানেই এক সামাজিক অনুষ্ঠানে তার পরিচয় হয় কাউন্ট আলেক্সেই ভ্রনস্কি নামের এক তরুণ, আকর্ষণীয় এবং উচ্চবংশীয় সেনা অফিসারের সঙ্গে। প্রথম দেখাতেই ভ্রনস্কি আন্নার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে তারাও এক গভীর প্রেমে জড়িয়ে পড়েন।
এই সম্পর্ক সমাজ, ধর্ম এবং পারিবারিক অনুশাসনের চোখে ‘ব্যভিচার’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। স্বামী কারেনিন বিষয়টি জানতে পেরে আন্নাকে সম্পর্ক ছিন্ন করার অনুরোধ করেন। কিন্তু আন্না ভ্রনস্কিকে ভালোবাসতে শুরু করেছেন এতটাই গভীরভাবে, যে তিনি সেই বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না।
সামাজিক তিরস্কার ও মানসিক অবক্ষয়-
ভ্রনস্কির সন্তানের মা হওয়ার পরও সমাজে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। তিনি তার স্বামী এবং ছেলেকে ছেড়ে ভ্রনস্কির সঙ্গে বসবাস শুরু করেন কিন্তু বৈধতা না থাকায় সে সম্পর্ক ক্রমে বিষিয়ে ওঠে।
আন্নার মানসিক অবস্থাও দিন দিন ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ভ্রনস্কির ওপর সন্দেহ, নিজেকে ত্যাজ্য মনে করা, সমাজের অবজ্ঞা এবং নিঃসঙ্গতা তাকে এক অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে।
অবশেষে আন্না এমন এক জায়গায় পৌঁছে যান, যেখান থেকে তার ফিরে আসার আর কোনো পথ থাকে না।
করুণ পরিণতি-
একদিন এক ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি একটি ট্রেন লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যা করেন। আন্নার এই পরিণতি কেবল এক প্রেমিকার না বরং এক নারীর আত্মসম্মান, ভালোবাসা, সমাজবদ্ধতার বিপরীতে এক অসহায় আত্মসমর্পণ।
বিপরীত ছায়া- লেভিনের জীবন-
উপন্যাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন কনস্টান্টিন দিমিত্রিচ লেভিন, যিনি বাস্তবিকভাবে লেখক তলস্তয়ের প্রতিচ্ছবি। তিনি একজন জমিদার, যিনি কৃষিকাজ ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। প্রেমিকা কিটি শেরব্যাতস্কায়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং পরে বিবাহ- এই অংশে লেখক জীবন ও ভালোবাসার একটি ইতিবাচক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।
লেভিন ধর্ম, সমাজ, মানবতা নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন। আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে তিনি জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পান। এই চরিত্রের মাধ্যমে তলস্তয় আশা ও জীবনের শক্তিকে তুলে ধরেছেন- যা আন্নার বিপরীতধর্মী চিত্র।
সাহিত্য মূল্যায়ন-
“আন্না কারেনিনা” শুধু রাশিয়ান সাহিত্যের নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত। উপন্যাসের চরিত্রগুলো বাস্তব, মনস্তত্ত্ব গভীর ও সামাজিক প্রেক্ষাপট সময়োপযোগী। এটি এক নারীকে কেন্দ্র করে লেখা প্রেম ও সমাজের অসাধারণ কাহিনি- যার প্রভাব আজও পাঠকের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে।
- সংক্ষিপ্ত অনুবাদক: এফ. আর. ইমরান

