‘আরো এক পৃথিবী’ এটি সাদাত হোসাইনের লেখা একটি প্রেমের উপন্যাস। এটি ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়।
পটভূমি ও প্রধান চরিত্র:
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র আরিয়ান—একজন চিন্তাশীল, জিজ্ঞাসু, আত্মসন্ধানী যুবক। সমাজে চলমান ভণ্ডামি, অবিচার, অস্থিরতা আর মেকি মানবিকতার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আরিয়ান কোনো প্রতীকি চরিত্র নয় বরং আমাদের আশেপাশেই থাকা এমন একজন, যে জীবনকে দেখে ভিন্নভাবে, অনুভব করে গভীরভাবে।
আরিয়ান বিশ্বাস করে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেয়ে মানুষ হয়ে ওঠা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সে প্রশ্ন তোলে সমাজের বদ্ধ মূল্যবোধ, হিপোক্রেসি আর মানুষের নির্মম নিঃসঙ্গতার বিরুদ্ধে।
গল্পের বিস্তৃত ধারা:
আরো এক পৃথিবী মূলত এক মানসিক ও আত্মিক যাত্রার গল্প। গল্পের শুরুতে আমরা দেখি, আরিয়ান একটি একাকীত্বগ্রস্ত, চিন্তায় নিমগ্ন মানুষ, যাকে এই দুনিয়ার বাস্তবতা—বিশেষ করে শহুরে জীবনের কোলাহল, আত্মকেন্দ্রিকতা ও অবিচার গভীরভাবে আঘাত করেছে। সে একটি “অন্যরকম পৃথিবীর” সন্ধানে নেমেছে, যেখানে মানুষ ভালোবাসে বিনা স্বার্থে, যেখানে সম্পর্ক হয় গভীর, নির্মল ও মানবিক।
এই খোঁজে বেরিয়ে সে একের পর এক মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে, প্রেমে পড়ে, আবার হারায়। তার জীবনে আসে একাধিক চরিত্র, যারা কেউ প্রেমিকা, কেউ বন্ধু, কেউ প্রতিপক্ষ—তবে প্রত্যেকেই তার উপলব্ধিকে আরও ঘনীভূত করে তোলে।
আরিয়ান যেন ধীরে ধীরে বুঝে ওঠে, এই পৃথিবীই আসলে শেষ নয়। বাস্তবের রূঢ়তায় ভেঙে পড়লেও সে একটা “অন্তর্জগতে তৈরি করা পৃথিবী” কল্পনা করে নেয়, যেখানে সে নিজের আদর্শ, আবেগ, অনুভব নিয়ে বাঁচতে চায়। এটাই তার কাছে “আরো এক পৃথিবী”।
ভালোবাসা, হারানো, উপলব্ধি:
এই উপন্যাসে প্রেম আছে, তবে তা শুধুই রোমান্টিক প্রেম নয়। প্রেম এখানে একধরনের মুক্তি—যা মানুষকে নতুন চোখে জীবনকে দেখতে শেখায়। আরিয়ান এক নারীর প্রেমে পড়ে, যার সঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গি মেলে কিন্তু বাস্তবতা তাদের সম্পর্ককে শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে দেয় না। সম্পর্ক হারিয়ে গেলেও সেই প্রেম তাকে আরও পরিপক্ব করে তোলে।
উপন্যাসের প্রেম-ভাঙা-আত্মানুসন্ধানের যাত্রা পাঠককে একধরনের ‘সৌন্দর্যবোধ’ শেখায়, যা শুধুমাত্র গল্প পড়ে নয়, জীবনের বাস্তবতায় অনুভব করা যায়।
দর্শন ও আত্মপ্রশ্ন:
আরো এক পৃথিবী কেবল গল্প নয় বরং একধরনের জীবনদর্শন। লেখক পাঠককে জিজ্ঞেস করিয়ে দেন—
- আমরা যে পৃথিবীতে বেঁচে আছি, তা কি আদৌ আমাদের?
- আমরা কি আসলে ভালোবাসতে জানি?
- মানুষ কি নিজেকে বুঝে উঠতে পারে? নাকি অন্য কেউ আমাদের ব্যাখ্যা করে দেয়?
আরিয়ান এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজে একা একা। তার আত্মজিজ্ঞাসা, চিন্তার জটিলতা এবং হারানোর অনুভব উপন্যাসটিকে এক গভীর জীবনঘনিষ্ঠ রূপ দেয়।
শেষ পর্যন্ত কী ঘটে?
উপন্যাসের শেষাংশে, আরিয়ান বুঝতে পারে, সে যে “আরো এক পৃথিবী” খুঁজে ফিরছিল—তা বাইরে নেই, সেই পৃথিবী আছে তার মনের ভেতরে। বাস্তবকে অস্বীকার না করে বরং তাকে বদলানোর স্বপ্ন ও সাহসই মানুষকে ভিন্ন করে তোলে।
তার এই উপলব্ধি, আত্মশুদ্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরই উপন্যাসের আসল অর্জন।
উপসংহার:
আরো এক পৃথিবী একটানা পড়া যায় না—পড়তে পড়তে থেমে ভাবতে হয়, কখনো ভেতরে কাঁপন ধরে, কখনো নীরব হয়ে যেতে হয়।
এটি একটি মননশীল পাঠ—যা পাঠককে কেবল বিনোদন দেয় না বরং নিজের জীবনকেও নতুন করে ভাবতে শেখায়।

