“জলপাইহাটি ডায়েরি” উপন্যাসের লেখক হচ্ছেন ইমদাদুল হক মিলন। তিনি বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক, যিনি গ্রামীণ জীবন, সমাজ ও মানুষের মনস্তত্ত্বের উপর গভীরভাবে আলোকপাত করেছেন। এই উপন্যাসটি ১৯৯০-এর দশকে প্রকাশিত হয় এবং এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের চিত্র তুলে ধরে। উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক গ্রামের সাধারণ মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম ও সম্পর্কের জটিলতা বর্ণনা করেছেন।
প্রেক্ষাপট-
বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের এক অতি সাধারণ ও বাস্তব জীবনের কথা বলে ‘জলপাইহাটি ডায়েরি’। উপন্যাসটি মূলত জলপাইহাটি নামে এক ছোট্ট গ্রাম ও তার মানুষের জীবন, চ্যালেঞ্জ, আশা-আকাঙ্ক্ষা আর সমাজের নানা অনিয়ম ও পরিবর্তনের গল্প বর্ণনা করে।
গল্পের শুরু-
উপন্যাসের শুরুতেই আমরা জলপাইহাটি গ্রামের ছোট ছোট মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হই। গ্রামের লোকেরা মূলত কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী। তাদের মধ্যে রয়েছে নানা চরিত্র– যেমন খোকা, মামুন, রাশেদা, আলী বাবু, মনি, ফুলবী ইত্যাদি। প্রতিটি চরিত্র গ্রামের সামাজিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তর ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে।
খোকা, উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। একজন সাধারণ কৃষক ছেলেটি, যার স্বপ্ন গ্রামের মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনা। সে গ্রামে আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে চায় কিন্তু প্রচলিত পুরোনো বিশ্বাস ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে তাকে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
গ্রামের জীবন ও সমস্যা-
জলপাইহাটি গ্রামের জীবনে অর্থনৈতিক দিক থেকে চলমান সংকট, শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্য সেবার দুরবস্থা স্পষ্ট। বিশেষ করে নারীদের অবস্থান খুবই কষ্টকর; তারা সামাজিক অবরোধ, বৈষম্যের শিকার। রাশেদা ও ফুলবী দুই মেয়ে চরিত্রের মাধ্যমে উপন্যাস নারীশিক্ষা ও নারীর মুক্তির কথাও বলছে।
গ্রামের প্রধান সমস্যা হল দরিদ্রতা, বেকারত্ব, সামাজিক বিচারবিভ্রাট এবং দালালের দৌরাত্ম্য। আলী বাবু নামে এক দালাল ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি গ্রামের সম্পদ ও মানুষদের অধিকার হরণ করে।
খোকার সংগ্রাম-
খোকা ছেলেটির আধুনিকতার আগমন ঘটাতে চাওয়ায় গ্রামের কিছু মানুষ তার প্রতি বিরক্ত। সে চেষ্টা করে কৃষির আধুনিক পদ্ধতি চালু করতে, নতুন বীজ আনতে, স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে এবং নারীদের শিক্ষা বৃদ্ধি করতে। কিন্তু সামাজিক বাধা, অর্থের অভাব এবং ক্ষমতাসীন দালালদের বাধা তাকে সাফল্যের পথে ব্যাহত করে।
তবে খোকা হাল ছাড়ে না। সে গ্রামের মানুষের মধ্যে একাত্মতা ও ঐক্যের বাণী প্রচার করে, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে সংগঠিত হয়। এই অংশে উপন্যাসে গ্রামের মানুষের মধ্যকার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চিত্র অতি প্রাণবন্তভাবে উঠে আসে।
অপব্যবহার ও ক্ষমতার খেলাপ-
আলী বাবু গ্রামে বিভিন্ন ধরণের অন্যায়-অবিচার চালিয়ে যায়। সে ক্ষমতার দাপটে গ্রামের গরীব কৃষক ও শ্রমজীবীদের শোষণ করে। তার বিরুদ্ধে খোকা ও তার সংগঠিত মানুষের প্রতিবাদ ও আন্দোলন উপন্যাসের উত্তেজনাপূর্ণ অধ্যায়।
এখানে সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিত্র যেমন উঠে এসেছে, তেমনি ব্যক্তিগত সম্পর্কের আবেগ, ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মত্যাগের বিষয়ও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
রাশেদা ও ফুলবীর গল্প-
রাশেদা ও ফুলবী নারীদের শিক্ষা ও মুক্তির প্রতীক। তারা গ্রামে নারী শিক্ষার পক্ষে কাজ করে কিন্তু সামাজিক বাধা, পরিবারের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব তাদের পথ কঠিন করে তোলে। রাশেদার সংগ্রাম নারীর আত্মপরিচয় গঠনের পথ দেখায়।
তাদের মধ্য দিয়ে উপন্যাস নারী স্বাধীনতা, শিক্ষার গুরুত্ব ও সামাজিক সচেতনতার বার্তা দেয়।
গল্পের শেষে খোকা ও গ্রামের মানুষের সংগ্রাম কিছুটা সফল হয়। যদিও পুরোপুরি সমাজের পুরনো অন্ধকার দূর হয় না কিন্তু আশা ও পরিবর্তনের বীজ বোনা হয়। গ্রামের মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করে।
উপন্যাসের মূল বক্তব্য হলো- গ্রামের মানুষের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ এবং সাহসিকতা ছাড়া সমাজে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। পাশাপাশি নারীর মুক্তি ও শিক্ষার গুরুত্ব অপরিহার্য।
‘জলপাইহাটি ডায়েরি’ একটি হৃদয়গ্রাহী গ্রামীণ গল্প, যেখানে বাস্তব জীবন ও সমাজের নানা দিক ফুটে উঠেছে প্রাণবন্তভাবে। এই উপন্যাস আমাদের শেখায়, সামাজিক পরিবর্তন সহজ নয় কিন্তু দৃঢ়চেতা মানুষের চেষ্টা তা সম্ভব করতে পারে।

