সপ্তাহের সাত দিনের মাঝে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ দিন হলো জুমাবার। এই দিনটি শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্য নয়, বরং পুরো সৃষ্টিজগতের জন্যই বরকতময়। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,
“জুমার দিন সপ্তাহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ: ১০৮৪)
তবে এই দিনের বরকত ও ফজিলত অর্জনের পূর্বশর্ত হচ্ছে—জুমার নামাজ যথাযথভাবে আদায় করা, এবং এর জন্য নির্ধারিত আদব ও প্রস্তুতি রক্ষা করা।
অনেকে বলেন, জুমার দিন হলো গরিবের হজের দিন! যদিও সরাসরি হাদিসে এ কথা নেই, তবে হাদিসে জুমার নামাজের প্রস্তুতি ও পদ্ধতি এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে, যাতে একধরনের হজসদৃশ পবিত্রতা ও গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়।
১. মেসওয়াক করা:
প্রতিটি নামাজের মতো, জুমার নামাজের ক্ষেত্রেও মেসওয়াক করা অত্যন্ত পছন্দনীয়। রাসুল (সা.) বলেন,
“আমার উম্মতের জন্য যদি কঠিন না হতো, তবে আমি প্রত্যেক নামাজের সময় মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।”
(সহিহ্ বুখারি)
২. গোসল করা:
জুমার দিন গোসল করা সুন্নত। রাসুল (সা.) বলেন,
“তোমাদের কেউ যদি জুমার নামাজে আসে, তাহলে সে যেন গোসল করে আসে।”
(সহিহ্ বুখারি)
৩. সুগন্ধি ও তেল ব্যবহার করা:
গোসলের পর শরীরে তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার করাও রাসুল (সা.)-এর প্রিয় আমল ছিল। এটি ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অংশ।
৪. ভালো ও পরিষ্কার পোশাক পরা:
জুমার দিনে সাধ্যানুযায়ী সুন্দর ও পরিষ্কার কাপড় পরা উত্তম। এতে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।
৫. আগেভাগে মসজিদে যাওয়া:
রাসুল (সা.) বলেন,
“ফেরেশতারা জুমার দিনে মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। যিনি প্রথম আসেন, তাঁর নামে একটি উট সদকা করার সওয়াব লেখা হয়… এরপর পর্যায়ক্রমে গাভি, মুরগি, ডিম… যখন খতিব উঠে দাঁড়ান, তখন ফেরেশতারা তাদের খাতা বন্ধ করে দিয়ে খুতবা শোনেন।”
(সহিহ্ বুখারি: ৮৮২)
৬. পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া:
যদি সম্ভব হয়, বাহনে না উঠে পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া বিশেষ সওয়াবের কাজ।
“যে ব্যক্তি গোসল করে, সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হেঁটে মসজিদে যায়, ইমামের কাছে বসে খুতবা শুনে এবং কোনো অনর্থক কাজে লিপ্ত না হয়—তার প্রতিটি পদক্ষেপে এক বছরের নফল রোজা ও নামাজের সওয়াব লেখা হয়।”
(সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৫, তিরমিজি: ৪৫৬)
৭. খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা:
খুতবার সময় চুপ থাকা ও মনোযোগ দেওয়া ফরজের পর্যায়ে। এ সময় কারো সঙ্গে কথা বলা বা মনোযোগ হারানো গোনাহের কাজ।
প্রস্তুতির সারসংক্ষেপ:
✅ মেসওয়াক করা
✅ অজু ও গোসল করা
✅ তেল ও সুগন্ধি লাগানো
✅ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা
✅ আগেভাগে মসজিদে যাওয়া
✅ পায়ে হেঁটে যাওয়া (যদি সম্ভব হয়)
✅ খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা
যদি একজন মুসলিম এসব সুন্নত রক্ষা করে জুমার নামাজ আদায় করে, তবে মহানবী (সা.) বলেন—
“এক জুমা থেকে আরেক জুমা পর্যন্ত যত গোনাহ হয়েছে, তা মাফ করে দেওয়া হয়।”
(সহিহ্ বুখারি)
জুমার দিন শুধু নামাজেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এই দিনে আরও কিছু অতিরিক্ত আমল রয়েছে, যেগুলো প্রচুর ফজিলতপূর্ণ:
সুরা কাহাফ তিলাওয়াত:
“যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহাফ পাঠ করে, তার জন্য দুই জুমার মাঝখানে নূর (আলো) সৃষ্টি হয়।”(মুসনাদ আহমাদ)
বেশি বেশি দরুদ পাঠ:জুমার দিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করতে বলা হয়েছে। এতে অগণিত বরকত বর্ষিত হয়।
দোয়া করা:জুমার দিন একটি বিশেষ সময় রয়েছে—যখন কোনো মুমিন বান্দার দোয়া ফেরত যায় না। কেউ জানে না সেই সময়টি কখন, তাই পুরো দিনই দোয়ায় ব্যস্ত থাকা উত্তম।
দান-সদকা করা:জুমার দিনে দান করা বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। এটি হলো ইবাদতের এক উত্তম রূপ।
যদি কোনো বৈধ কারণে (যেমন—প্রচণ্ড বৃষ্টি, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি) মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় সম্ভব না হয়, তাহলে ঘরে থেকেই যোহরের চার রাকাত ফরজ নামাজ পড়তে হবে। তবে দুঃখ প্রকাশ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে সেই নিয়ত অনুযায়ী সওয়াব আশা করা যায়।
জুমাবার শুধুই একটি নামাজের দিন নয়—এটি মুসলমানদের জন্য এক নবজাগরণের দিন, ফজিলতের দিন, কল্যাণের দিন। এই দিনটিকে পূর্ণতা দিতে হলে আমাদের প্রয়োজন যথাযথ প্রস্তুতি, আত্মশুদ্ধি, মনোযোগ ও আমল।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে জুমার দিনের আদব, আমল ও ফজিলতের প্রতি যত্নবান হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

