হিজরি সালের প্রথম মাস মহররম। পবিত্র কোরআনের ভাষায় এটি আল্লাহর সম্মানিত মাসগুলোর একটি। এই মাসের মর্যাদা শুধু সময়ের হিসেবে নয়, ইতিহাস ও আধ্যাত্মিক দিক থেকেও অসাধারণ। নবী করিম (সা.) নিজে এই মাসকে “আল্লাহর মাস” বলে উল্লেখ করেছেন। (সহিহ মুসলিম: ২৬৪৫)
আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন,
“আসমান ও জমিন সৃষ্টি হওয়ার দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি। তার মধ্যে চারটি সম্মানিত।”
(সূরা তাওবা, আয়াত ৩৬)
এই সম্মানিত চারটি মাস হলো: জিলকদ, জিলহজ, মহররম (ধারাবাহিক তিনটি) এবং রজব (আলাদা)।
মহররমের ১০ তারিখ, যাকে আশুরা বলা হয়, ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আশুরার রোজার মাধ্যমে আমি আশাবাদী, আল্লাহ পূর্ব বছরের গুনাহসমূহ মাফ করে দেবেন।”
(সহিহ মুসলিম: ১১৬২)
রাসুল (সা.) আশুরার রোজার সঙ্গে ইহুদি সম্প্রদায়ের মিল না রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখে দুটি রোজা রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন। কেউ কেউ তিন দিন—৯, ১০ ও ১১ তারিখে রোজা রাখাকে উত্তম বলে থাকেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন,
“রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস—মহররমের রোজা।”
(সহিহ মুসলিম: ২৬৪৫)
মহররম কেবল রোজার মাস নয়, বরং তাওবার মাস। আল্লাহ তায়ালা এক সম্প্রদায়ের তাওবা এই মাসেই কবুল করেছিলেন। (তিরমিজি: ৭৪১) আমাদের জন্যও এ মাস হতে পারে ফিরে আসার সুবর্ণ সুযোগ।
মহররমে যা থেকে বিরত থাকা জরুরি
১. গুনাহ ও জুলুম পরিহার
আল্লাহ বলেন,
“এই চার মাসে তোমরা নিজেদের ওপর জুলুম কোরো না।”
(সূরা তাওবা: ৩৬)
গুনাহই তো সবচেয়ে বড় জুলুম। তাই এই পবিত্র মাসে আরও বেশি সতর্ক হওয়া আবশ্যক।
২. বিধর্মীদের সাদৃশ্য বর্জন
ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিন এককভাবে রোজা রাখত ও উৎসব পালন করত। রাসুল (সা.) তাদের ভিন্নভাবে পালন করতে বলেন—রোজার সঙ্গে একটি অতিরিক্ত দিন যুক্ত করে।
৩. মাতম, মর্সিয়া, গায়ে আঘাত ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা
হযরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের শোক প্রকাশে অনেকে শরীর আঘাত করে, জামা ছিঁড়ে মাতম করে—যা ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। রাসুল (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি গায়ে চপেটাঘাত করে, জামা ছিঁড়ে ফেলে, জাহেলিয়াত যুগের মতো আহাজারি করে—সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
(বুখারি: ১২৯৭)
৪. আশুরাকে শুধুই কারবালার দিন মনে করা
অনেকেই ভুলভাবে মনে করেন আশুরা মানেই কেবল কারবালার স্মৃতি। বাস্তবে আশুরার ফজিলত ইসলাম-পূর্ব যুগ থেকেই বিদ্যমান।
রাসুল (সা.) মদিনায় এসে দেখেন, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তারা বলেন,
“এটি সেই দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.)-কে মুক্তি দিয়েছেন, আর ফেরাউন ধ্বংস হয়েছেন।”
তখন রাসুল (সা.) বলেন,
“আমরা মুসা (আ.)-এর অনুসারী হওয়ার অধিক হকদার।”
(সহিহ মুসলিম: ২৫৪৮)
মহররম মাস কেবল একটি দিন কিংবা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়—বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত, রহমত ও আত্মশুদ্ধির এক মহান সুযোগ। এই মাসে আমরা যেন শুধুমাত্র রোজা নয়, নিজের অন্তরকেও পরিশুদ্ধ করি। গুনাহ থেকে বিরত থাকি, ইবাদতে মনোযোগী হই এবং সমাজে শান্তি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে মহররম মাসের মর্যাদা বুঝে যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

