ইতিহাসের পাতায় কিছু দিন থাকে, যেগুলো সময়ের সীমা ছাড়িয়ে চিরন্তন হয়ে ওঠে। তেমনই এক মহিমান্বিত দিন হলো আশুরা, অর্থাৎ হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররমের দশম দিন। এ দিন শুধু ইসলামের ইতিহাসেই নয়, গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বহুমাত্রিক গুরুত্ব বহন করে—যেখানে রয়েছে আসমানি বরকত, নবুয়তের স্মৃতি, আত্মত্যাগের অনন্য নজির এবং মানবিক শিক্ষা।
যদিও আশুরা সম্পর্কিত অনেক ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের বিভিন্ন বইয়ে বর্ণিত, তবে সবকটির তথ্য সমানভাবে প্রমাণিত নয়। তারপরও যুগ যুগ ধরে এগুলোর শিক্ষা ও তাৎপর্য মুসলিম সমাজে মূল্যায়িত হয়ে আসছে। নিচে তুলে ধরা হলো আশুরা-সংক্রান্ত সেই ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক ঘটনাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ—
১. আসমান-জমিনের সৃষ্টি: এই দিনেই আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেন আসমান, জমিন এবং কলম।
২. আদম (আ.)-এর সৃষ্টি ও তাওবা কবুল: মানবজাতির পিতা আদম (আ.) এই দিনেই সৃষ্টি হন এবং তাঁর তাওবা গ্রহণ করা হয়।
৩. ইদ্রিস (আ.)-এর আসমানে উত্থান: আল্লাহর নির্দেশে ইদ্রিস (আ.)-কে আসমানে তুলে নেওয়া হয়।
৪. নুহ (আ.)-এর জাহাজের নিরাপদ অবতরণ: ভয়াবহ মহাপ্লাবনের পর জাহাজটি আশুরার দিনেই জুদি পাহাড়ে ভেড়ে।
৫. ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য আগুন শীতল হওয়া: আল্লাহর আদেশে আগুন হয়ে যায় শীতল ও নিরাপদ।
৬. ইসমাইল (আ.)-এর জন্ম: ত্যাগ ও কোরবানির প্রতীক ইসমাইল (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এই দিনে।
৭. ইউসুফ (আ.)-এর কারামুক্তি: মিসরের জেল থেকে মুক্তি পান এবং রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
৮. ইউসুফ (আ.) ও ইয়াকুব (আ.)-এর পুনর্মিলন: দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর পিতা-পুত্রের আবেগঘন মিলন ঘটে।
৯. মুসা (আ.) ও বনি ইসরাঈলের মুক্তি: ফেরাউনের অত্যাচার থেকে লাল সাগর পাড়ি দিয়ে রক্ষা পান।
১০. তাওরাত নাজিল: আল্লাহর কিতাব তাওরাত এই দিনেই মুসা (আ.)-কে দেওয়া হয়।
১১. সুলাইমান (আ.)-এর রাজত্ব পুনরুদ্ধার: সাময়িকভাবে হারানো সিংহাসন ফিরে পান।
১২. আইয়ুব (আ.)-এর রোগমুক্তি: ধৈর্যের পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তাঁকে সুস্থতা দান করেন।
১৩. ইউনুস (আ.)-এর মাছের পেট থেকে মুক্তি: ৪৪ দিন পর এই দিনেই মুক্তি পান।
১৪. ইউনুস (আ.)-এর জাতির তাওবা কবুল: তাঁর জাতি আল্লাহর গজব থেকে রক্ষা পায়।
১৫. ঈসা (আ.)-এর জন্ম: এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন নবী ঈসা (আ.)।
১৬. ঈসা (আ.)-এর আসমানে উত্তোলন: আল্লাহ তাঁকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করে আসমানে তোলেন।
১৭. প্রথম রহমতের বৃষ্টি: পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো বরকতময় বৃষ্টি নেমেছিল এই দিনে।
১৮. কাবা শরিফে গিলাফ পরিবর্তন: কুরাইশরা এই দিনে কাবা ঘরের গিলাফ পাল্টাতেন।
১৯. রাসুল (সা.) ও খাদিজা (রা.)-এর বিবাহ: এই শুভদিনেই রাসুল (সা.) বিবাহ করেন খাদিজা (রা.)-কে।
২০. কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনা: হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এই দিনে সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন।
২১. কিয়ামতের দিনও আশুরা হবে (অনুমান): হাদিস অনুসারে অনেক আলেমের বিশ্বাস—এই দিনেই সংঘটিত হবে কিয়ামত।
পবিত্র আশুরা আমাদের শিক্ষা দেয়—সত্যের পথে আত্মত্যাগই মানবতার শ্রেষ্ঠ আদর্শ। ইমাম হোসেন (রা.)-এর কারবালার ত্যাগ শুধু ইতিহাস নয়, বরং প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে জাগ্রত এক মহাস্মৃতি।
এই দিনে কেবল অতীত স্মরণ নয়, বরং বর্তমান জীবনে সত্য, ন্যায় ও নেক আমলের প্রতি আত্মনিয়োগের প্রতিজ্ঞা নেওয়ার সময়। বেশি বেশি ইবাদত, রোজা, তওবা ও আল্লাহর স্মরণেই হোক আশুরা উদযাপন।

