জীবন একটি পরীক্ষার মাঠ। কখনো কখনো পরীক্ষাগুলো সহজ হলেও অনেক সময় সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী এবং দুর্বিষহ হয়। বিশেষ করে এমন কিছু সংকট আসে, যার শেষ কোথায় তাও স্পষ্ট হয় না। সেসব সময় মানুষ হতাশায় ডুবে যেতে পারে। কিন্তু ইসলামী জীবনবোধ এই দুঃসহ সময়েও একজন মুমিনকে পথ দেখায় শান্তি, সহনশীলতা এবং দৃঢ়তার।
ইসলামে বিশ্বাস করা হয়, জীবন ভাগ্যের অন্তর্গত এবং সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটে। যদিও মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী, তবুও শেষ বিচারে আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত। ভাগ্য ও তাকদিরে বিশ্বাস করা ইমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্যই ইমানের ঘোষণা ‘আমানতু বিল্লাহি…ওয়াল কাদরি খইরিহি ওয়াশাররিহি মিনাল্লাহি তাআলা’ (ভালো-মন্দ তাকদির আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্ধারিত) এই বক্তব্য দিয়ে পূর্ণ হয়।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, “যা তোমার জন্য নির্ধারিত নয়, তা কখনোই তোমার হতে পারে না। আর যা তোমার জন্য নির্ধারিত, তা কখনো এড়ানো যাবে না” (ইমাম নববির ৪০ হাদিস, হাদিস: ১৯)। এই হাদিসে গভীর এক মানসিক প্রশান্তির উৎস রয়েছে। অনিশ্চয়তার মাঝে এই বিশ্বাস একজন মানুষের মনকে সংহত করে এবং তাকে ভাগ্যের বাস্তবতা মেনে নিতে সহায়তা করে।
মানুষ যখন দীর্ঘমেয়াদী সংকটে পড়ে, তখন ইসলামী দর্শন তাকে আখিরাতের দিকে মনোনিবেশ করতে বলে। কঠিন সময় স্মরণ করিয়ে দেয় যে দুনিয়াটা ক্ষণস্থায়ী, আর স্থায়ী জীবনের ঠিকানা হলো আখিরাত। এই দৃষ্টিভঙ্গি একজন মানুষকে সাময়িক কষ্টকে সহ্য করার শক্তি দেয়। যে কষ্ট তাকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যায়, তা আসলে নিয়ামত হয়ে দাঁড়ায়।
ধৈর্য, যার আরবি প্রতিশব্দ ‘সবর’, ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। আল্লাহ বলেন, “আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ক্ষয়, জীবনহানি ও ফসলের ক্ষতিসহ নানা কষ্ট দিয়ে। তাই ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও” (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)। ইসলামী ব্যাখ্যায় ধৈর্য মানে শুধুই নিঃক্রিয়ভাবে সহ্য করা নয়; বরং নিয়ন্ত্রণহীন বাস্তবতাকে গ্রহণ করে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
মুমিন জানে যে, আল্লাহর পরিকল্পনায় রহস্য লুকিয়ে থাকে। কুরআনে হযরত মুসা (আ.) ও খিজিরের ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে বাহ্যিকভাবে বেদনাদায়ক ঘটনাগুলোর পিছনে দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ ছিল। মুমিনের জন্য এসব উদাহরণে রয়েছে শিক্ষা- দেখতে যতই দুর্বিষহ হোক, আল্লাহর সিদ্ধান্তে আছে পরম কল্যাণ।
মানুষকে নিজের হতাশায় ডুবে না গিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ইসলামী আদর্শ উৎসাহ দেয়। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি” (সূরা ইনশিরাহ, আয়াত: ৫)। তাই মুমিন কষ্টের ভেতর থেকেও ভালো দিক খুঁজে নেয়, শান্তির উৎস খোঁজে পরিবার, বন্ধু বা ইবাদতের মাধ্যমে। নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে ব্যবহার করে সে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়।
এছাড়াও কুরআন মুমিনকে স্পষ্ট ভাষায় নিরাশ না হওয়ার নির্দেশ দেয়: “আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে কেবল কাফিররাই নিরাশ হয়” (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৮৭)। নবী করিম (সা.)-এর বাণী অনুসারে, “পুরো জাতি তোমাকে সাহায্য করতে চাইলেও আল্লাহ না লিখলে কিছুই হবে না, আবার তারা তোমার ক্ষতি করতেও পারবে না যদি আল্লাহ না চান” (ইমাম নববির ৪০ হাদিস, হাদিস: ১৯)।
সবশেষে, যে কেউ কঠিন সময়ে পড়লে ইসলামের শিক্ষা হলো ভাগ্যের সত্যতা মেনে নিয়ে ধৈর্য ও আশা নিয়ে জীবন কাটানো, আল্লাহর পরিকল্পনার উপর নির্ভর করা এবং আখিরাতমুখী জীবন যাপন করা। এই বিশ্বাসই সংকটময় জীবনে শান্তি ও প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
সূত্র: মুসলিম ম্যাটার্স

