প্রশ্ন: জাহাজ রপ্তানির ক্ষেত্রে নানা উত্থান-পতন দেখা যায়। সর্বশেষ অবস্থা কেমন?
সোহেল হাসান: জাহাজ রপ্তানিতে অমিত এক সম্ভাবনা ছিল বাংলাদেশের। পর পর বেশ কয়েকটি জাহাজ রপ্তানিও হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। নানা কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে যাওয়ায় হোঁচট খেয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। এখন আবার নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে আমাদের। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা জাহাজ আবার যাচ্ছে বিদেশে। আশা করছি জাহাজ নির্মাণ খাতে এখন আবার প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এতে করে নতুন ক্রয়াদেশ আসার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনাদের জাহাজ রপ্তানি কবে থেকে শুরু হয়?
সোহেল হাসান: বিদেশে জাহাজ রপ্তানি করা বড় প্রতিষ্ঠান আছে দুটি। একটি আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ। এটি ঢাকার প্রতিষ্ঠান। আরেকটি চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। বাংলাদেশ থেকে প্রথম জাহাজ রপ্তানি করে ঢাকার আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ। ২০০৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ডেনমার্কে জাহাজ রপ্তানির মাধ্যমে নতুন এই দিনের সূচনা করে তারা। ২০১০ সালে জাহাজ রপ্তানিতে যুক্ত হয় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। ২০১০ সালেরই ৩০ নভেম্বর প্রথম আমরা জার্মানিতে একটি সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করি।
প্রশ্ন: ওয়েস্টার্ন মেরিন সর্বশেষ জাহাজ রপ্তানি করে পাঁচ বছর আগে। এর পর আবার শুরু করে ২০২৫ সালে। কীভাবে আবার সুদিনে ফিরলেন?
সোহেল হাসান: দীর্ঘ বিরতির পর ২০২৫ সালে প্রথমে আরব আমিরাত গেছে ওয়েস্টার্ন মেরিনের তৈরি ‘এমভি রায়ান’ নামের জাহাজটি। এটির ক্রেতা আরব আমিরাতের মারওয়ান শিপিং লিমিটেড। ২০১৭ সালেও একই ক্রেতার কাছে আমরা একটি ল্যান্ডিং ক্রাফ্ট রপ্তানি করেছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন অর্ডার পেয়েছি। মারওয়ান শিপিংয়ের কাছে চারটি ল্যান্ডিং ক্রাফ্ট ভেসেল, দুটি টাগবোট এবং দুটি অয়েল ট্যাঙ্কারসহ আটটি জাহাজ বিক্রির জন্য ২০২৩ সালে চুক্তি করে ওয়েস্টার্ন মেরিন। এর অংশ হিসেবেই ‘রাইয়ান’ এবং ‘খালিদ’ ও ‘ঘায়া’ নামে দুটি উচ্চ ক্ষমতার টাগবোট চলতি বছর রপ্তানি করা হয়। বাকি জাহাজ চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ের মধ্যে হস্তান্তর করা হবে।
প্রশ্ন: মোট কতগুলো জাহাজ তৈরির অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনাদের?
সোহেল হাসান: গত দুই দশকে আমরা বিভিন্ন ধরনের ১৫০টিরও বেশি জাহাজ তৈরি করেছি। এর মধ্যে আছে বড় জাহাজ, কার্গো জাহাজ, যাত্রীবাহী জাহাজ, মাল্টিপারপাস আইস-ক্লাস ভেসেল, ল্যান্ডিং ক্রাফ্ট, অফশোর প্যাট্রল ভেসেল, টাগবোট, মাছ ধরার জাহাজ, বাল্ক ক্যারিয়ার ও কনটেইনার ক্যারিয়ার। শিগগির আরও অন্তত আটটি জাহাজ পর্যায়ক্রমে রপ্তানি করব। আমরা এ পর্যন্ত বিশ্বের ১২টি দেশে ৩৪টি বড় জাহাজ রপ্তানি করেছি; যেগুলোর দাম সব মিলিয়ে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
প্রশ্ন: জাহাজ নির্মাণের ক্রয়াদেশ এখন কেমন পাচ্ছেন? এটি হোঁচট খেয়েছিল কখন?
সোহেল হাসান: মহামারি করোনার সময় জাহাজ নির্মাণশিল্প সংকটের মুখে পড়ে। তখন সারাবিশ্বেই জাহাজ নির্মাণের ক্রয়াদেশ কমতে থাকে। মহামারি শেষ হওয়ার পরও অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার কারণে এই শিল্প অনেক দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ অবস্থায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই অনেক শিপইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও অনেক শিপইয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেছে। তখন আমরাও অনেক সংকটে পড়ে যাই। বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় তখন আমরা দেশীয় ক্রেতার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে আমরা জাহাজ নির্মাণের নতুন নতুন ক্রয়াদেশ পাচ্ছি।
প্রশ্ন: জাহাজশিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনের কারণ কী?
সোহেল হাসান: দেশীয় জাহাজশিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর নেপথ্যে কয়েকটি কারণ রয়েছে। ইউরো জোন ক্রাইসিসের সমাধান হওয়ায় বৈশ্বিক আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বেড়ে গেছে। এ কারণে বিদেশি অনেক ক্রেতা আবারও জাহাজ তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আবার সরকার ২০২১ সালে জাহাজ নির্মাণশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা করে দেওয়ায় উদ্যোক্তারা করোনার পর আগের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এ দুই কারণে এখন এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প সুদে অর্থায়নের ক্ষেত্রে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রথা অনুযায়ী, একটি জাহাজের অর্থায়নের প্রায় ৮৫ শতাংশই ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে আসে। বাকি ১৫ শতাংশ, যার পরিমাণ ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা (২.৫ থেকে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) নিজেদের তহবিল থেকে জোগাড় করতে হয়। ব্যাংকগুলো প্রায়ই এতে অংশ দিতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে উৎপাদনের সময় কার্যকরী মূলধন আটকে থাকে এবং দেরি হয়। এই বিষয়টির সমাধান হলে এই খাতে আরও কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে। (সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারোয়ার সুমন। সূত্রঃ সমকাল)