সম্প্রতি তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) চেয়ারম্যান ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ। দুর্নীতি, সুশাসন ও আগামী নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেছেন ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: এই কয়েক দিনের অভিজ্ঞতার পর আমার প্রধান অনুভূতি হলো, বাংলাদেশে নাগরিক সমাজ কতটা প্রাণবন্ত! টিআই বাংলাদেশের তরুণ কর্মীদের মধ্যে যেমন উদ্দীপনা, তেমনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, এমনকি তুলনামূলকভাবে সচেতন জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সম্পৃক্ততাও দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ক।
গত বছর বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ পুরো বিশ্বকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে। অবশ্যই এখানে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে। তবে মূল বিষয়টি হলো, ক্ষমতায় অবস্থান যেন জনগণের সেবার লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে নয়। এটি পুলিশ, বিচারপতি, রাজনীতিবিদ—সবার জন্য প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন হওয়া উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা, যেখানে কীভাবে তারা জনগণের সেবা করতে চান সেটি তুলে ধরবেন। এটা যেন ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা না হয়, যেখানে ক্ষমতা মানে ব্যক্তিগত লাভের সুযোগ। এই সমস্যাগুলো শুধু বাংলাদেশের নয়—আমি ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একই কথা বলব। সব দেশই এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি, আগের কর্তৃত্ববাদী শাসন কীভাবে বৈশ্বিক দুর্নীতির অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছে। এর মধ্যে টিআই বাংলাদেশ, টিআই ইউকে ও ‘স্পটলাইট অন করাপশনের’ যৌথ চেষ্টার ফলে ১৮৫ মিলিয়ন পাউন্ড লন্ডনে জব্দ করা হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে দুর্নীতির বৈশ্বিক অর্থনীতি, যা বছরে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এটি আসলে নাগরিকদের প্রতিদিনের সমস্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: দুদক, বিচার বিভাগ—এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আমাদের এই দাবি সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। এখানে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় স্পষ্ট করা উচিত, যেমন এসব প্রতিষ্ঠানকে শুধু সরকারের নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপই নয়; বরং সব রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ থেকেও মুক্ত রাখতে হবে। কারণ, অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলো বিচারপতি বা তদন্ত কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে। কাজেই এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, পদোন্নতি ও কাজের মূল্যায়ন—সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়োজন।
কাজটা যে কঠিন, তা আমি বুঝি। পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই গত বছর এ দেশের নাগরিকেরা নিজেদের জীবন দিয়ে বিপ্লব করেননি। তাঁরা সে অবস্থায় ফিরে যেতে চান না, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো লাভজনক পদগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবে।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: আমি বলব, দুর্নীতি দমন যেন কখনো রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা না হয়। যেমন আপনি বললেন, শুধু বিরোধীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়, এমনটা হওয়া উচিত নয়। অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও অতীতে এমনটি হয়েছে বলে মনে করা হয়। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আইন প্রয়োগ যেন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে না হয়। সরকারদলীয় হলে কিছু না করা আর বিরোধী দলে হলে দমন—এটা চলতে পারে না।
কাজটা কঠিন, আমি সেটি জানি। এটি সাহসেরও বিষয়। কারণ, দুর্নীতি দমনের মধ্যে প্রতিশোধের আশঙ্কাও থাকে। তাই পুরো নাগরিক সমাজকে এ প্রক্রিয়ার নজরদারির দায়িত্ব নিতে হবে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার কর্মীদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস জোগাতে হবে, যাতে তাঁরা যে কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পারেন, অভিযুক্ত ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক না কেন। এটাই আমাদের বর্তমান চ্যালেঞ্জ।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: রাজনৈতিক ক্ষমতা কখনোই লাভজনক বিষয় হতে পারে না; কিন্তু আমরা দেখেছি, অনেক দেশেই রাজনৈতিক ক্ষমতা একটি লাভজনক বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে। যাঁরা নির্বাচনী প্রচারণার জন্য অর্থ দেন, তাঁরা এটি বিনিয়োগ হিসেবে দেখেন।
রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ প্রদানকারী ব্যক্তি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমনকি বিদেশি শক্তিও হতে পারে। তারা রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থীদের গোপনে অর্থ দেয়। তারা এসব প্রকাশ করে না। অর্থায়নের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকাটাই প্রধান সমস্যা। এরপর যদি তাদের পছন্দের ব্যক্তি নির্বাচিত হন বা দল ক্ষমতায় আসে, তখন তাঁরা যে অর্থ দিয়েছেন, তার বিনিময়ে সুবিধা চান। তাঁরা তাঁদের টাকা ফেরত চান। আর টাকা ওই সব লোকজন বা প্রতিষ্ঠান ফেরত চায় সরকারি কেনাকাটার মাধ্যমে, যার মাশুল গুনতে হয় জনগণকে। তারা চায় কম খরচে সর্বোচ্চ মুনাফা করতে। অর্থাৎ নিম্নমানের পণ্য বা সেবা দিয়ে বেশি অর্থ আদায় করতে। এ কারণে জনগণের অর্থ চুরি হয় এবং সেবাও হয় নিম্নমানের, যার ফল ভয়াবহ হতে পারে। যেমন হাসপাতালের অকেজো সরঞ্জাম, ভবনের ধস, যা মানুষের প্রাণহানি ঘটায়।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অর্থায়নের প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি। তাই আমরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চাই। আমাদের দাবি খুব স্পষ্ট। রাজনৈতিক দল আর প্রার্থীদের কাছে টাকা কীভাবে আসছে, আর কীভাবে খরচ হচ্ছে, তাতে আমরা স্বচ্ছতা চাই। এ তথ্য শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছেই নয়, প্রকাশ্যে জনগণের কাছেও থাকতে হবে। অনেক দেশেই এখন এই তথ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করা হচ্ছে। এ ধরনের পাবলিক স্ক্রুটিনি দরকার।
নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রেও জনগণের জানার অধিকার আছে। যদি বলা হয়, একটি জায়গায় জনসভা হয়েছে; কিন্তু আসলে কিছুই হয়নি, কিংবা বড় একটি জনসভা হয়েছে অথচ খরচ দেখানো হয়নি, তাহলে জনগণকে সেটি দেখাতে ও বলতে দিতে হবে।
এই স্বচ্ছতাই রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ‘বাজারজাত’ হওয়া থেকে মুক্ত করতে পারে এবং নির্বাচনকে আইডিয়া ও সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিযোগিতা হিসেবে ফিরিয়ে আনতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এখানে জনগণের ভূমিকা আছে কি না? অবশ্যই আছে। জনগণের প্রয়োজন তথ্য। তারা যেন জানতে পারে, কীভাবে অর্থ আসছে, কীভাবে খরচ হচ্ছে; তাহলেই তারা এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ভুল ধরতে পারবে এবং কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে পারবে। জনগণই এই সরকারি অর্থের মালিক। জনগণই রাজনীতিবিদদের নিয়োগদাতা।
আমরা প্রত্যেকে ব্যাংকে নিজের টাকা রাখলে যেমন জানতে চাই—আমার টাকা কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে ব্যাংক ব্যবহার করছে, কত সুদ পাচ্ছি—ঠিক তেমনই, নাগরিকদেরও জানার অধিকার আছে, তাঁদের করের টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নাগরিকদের অধিকার আছে আর জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব আছে। এ সম্পর্ক যেন উল্টো না হয়ে যায়—জনপ্রতিনিধিদের যেন সব অধিকার আর নাগরিকদের শুধু দায়িত্ব না থাকে।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: বাংলাদেশের জনগণের গত বছরের অর্জন আমাকে আশাবাদী করেছে। দুর্নীতির যে চক্রের কথা আপনি বলছেন, সেটি এতটা শক্তিশালী ছিল না যে জনগণের আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে পারে। মানুষ রাস্তায় নেমেছে, জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে, প্রতিবাদ করেছে—এটা এক বিশাল বার্তা। হ্যাঁ, অনেক দেশে (বাংলাদেশসহ) একটা ধারণা প্রচলিত যে দুর্নীতি অনিবার্য—সব সময়ই থাকবে, কিছু করার নেই; কিন্তু গত বছরের ঘটনাগুলো দেখিয়ে দিয়েছে, সেটি সত্য নয়।
বাংলাদেশের জনগণ দেখেছে, কীভাবে আগের শাসকদের ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে। তাঁরা যতই দমন-পীড়ন চালাক, শেষ পর্যন্ত নিজেদের সুবিধা রক্ষা করতে পারেননি। তাঁদের পালাতে হয়েছে। এখন বাংলাদেশ তাঁদের সম্পদ ফেরত আনার চেষ্টা করছে। এটা একট বড় শিক্ষা।
এখন যেসব সংস্কারপ্রক্রিয়া চলছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৩৬ দিনের ‘জুলাই আন্দোলন’ আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে, এটা তো খুব সাম্প্রতিক অতীত। তাই আমি মনে করি, দুর্নীতি বাংলাদেশে যতটা প্রোথিত বলেই ধারণা করা হয়, বাস্তবে হয়তো তা নয়।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: বর্তমানে যেসব সংস্কার সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এখন ‘সংস্কার কমিশন’ ও ‘ঐকমত্য কমিশন’ কাজ করছে। তবে সম্ভবত সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত করা। এই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা উচিত আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই।
এর পাশাপাশি আমাদের জানতে হবে, দুর্নীতির অর্থ কোথায় যাচ্ছে? কে এর পেছনে আছে? এবং কীভাবে তা প্রতিরোধ করা যায়? এর জন্য একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা অপরিহার্য, যাতে প্রতিটি স্তরে সৎ ও দক্ষ লোকের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়, চাই সেটি বিচার বিভাগ হোক, চাই সেটি দুদক হোক। আমি এখন আত্মবিশ্বাসী যে দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করছে, আগের মতো দলীয় হাতিয়ার হিসেবে নয়।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: আমি যা বুঝেছি, তা হলো পবিত্র রমজান শুরুর আগেই (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা আছে। তবে কেউ যখন বলে ‘ধীরে চলুন’, ‘আরও সময় নিন’—দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামের ক্ষেত্রে এটা ভালো সংকেত নয়। দুর্নীতির ক্ষেত্রে দ্রুত ও ধারাবাহিক অগ্রগতি জরুরি।হ্যাঁ, তাড়াহুড়া করে খারাপ কাজও হতে পারে। তবে ‘তাড়াতাড়ি কিন্তু সঠিকভাবে’ করা সম্ভব।
এই অন্তর্বর্তী সরকার গত আগস্ট থেকেই কাজ করছে এবং অনেক কিছু করে ফেলেছে। এখন থেমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। যদি থেমে যায়, তাহলে একটি শূন্যতা তৈরি হবে। এই সরকার ইতিমধ্যে ভিত্তি স্থাপন করেছে, সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটা জনগণের প্রতি দায়। এর মানে এমন নয় যে সবকিছু এই সরকারই করে ফেলবে। সেটি সম্ভবও নয়। নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে, তারা যেন বলে না, ‘সব তো আগেই হয়ে গেছে, এখন কিছু করার নেই।’ দুই সরকারকেই একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: প্রকৃত গণতন্ত্র শুধু ভোটের সময় সক্রিয় থাকে না। নির্বাচন হয়, তারপর পাঁচ বছর জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। এরপর আবার ভোট হলে জনগণের কাছে ভোট চাওয়া—এমনটা হলে পুরোনো অনাচার আবার ফিরে আসবে। সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে, যে–ই জিতুক, যে দল ক্ষমতায় আসুক না কেন। কারণ, এটি কোনো দলীয় রাজনীতির বিষয় নয়; বরং ক্ষমতা ব্যবহারের ধরনের বিষয়। ক্ষমতা যেন জনগণের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, সেটিই মুখ্য। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থাকবে, মতপার্থক্য থাকবে, এটিই তো গণতন্ত্র। কিন্তু যে প্ল্যাটফর্মই জয়ী হোক না কেন, ক্ষমতার ব্যবহার যেন জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হয়, এটিই গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের বুঝতে হবে যে ক্ষমতা ব্যবস্থাপনায় গভীর সংস্কার প্রয়োজন। আর সেই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ যেন শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে হয়, এটিই মূলকথা। টিআইবির প্রতিবেদনের বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। মূল বিষয় হলো আমরা যেন আবার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার প্রক্রিয়ায় ফিরে না যাই। অতীতে যে ভয়াবহ পরিণতি হয়েছে, তা যেন আর না ঘটে।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: এই ব্যবধান দূর করার উপায় হলো, তথ্য। নাগরিকদের তথ্য জানতে হবে। এ জন্য সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টিআইবির প্রতিবেদন দেখে আমি উদ্বিগ্ন যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হুমকি, সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরিবেশ রয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, অনেক দেশেই এমন হচ্ছে। গোপনীয়তা হলো দুর্নীতির সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি। যতক্ষণ না তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে, নাগরিকেরা কিছু জানবেন না, প্রশ্ন তুলবেন না।
রাজনৈতিক অর্থায়ন, সরকারি ব্যয়, বাজেট—এসব বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করতে হবে। বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে তথ্য অধিকার আইন রয়েছে; কিন্তু অনেক নাগরিক জানেনই না, তাঁদের এই অধিকার আছে। এটি বড় একটি চ্যালেঞ্জ। গোপনীয়তার চর্চাই ক্ষমতার অপব্যবহারের হাতিয়ার। আমরা চাই, গোপনীয়তা যেন আর ক্ষমতার চর্চার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: আইন থাকা জরুরি, তবে সবচেয়ে জরুরি হলো আইনের প্রয়োগ। সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাই আইনের কার্যকর প্রয়োগ অপরিহার্য। যখন কোনো সাংবাদিককে হুমকি দেওয়া হয়, তিনি হেনস্তার শিকার হন, সেটি জনসমক্ষে আনতে হবে। কণ্ঠস্বরই আমাদের একমাত্র শক্তি। কিন্তু এটি তখনই সম্ভব, যখন গণতন্ত্র থাকে—যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রতিবাদের অধিকার থাকে।
যদি সব বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে কেউই সুরক্ষিত থাকে না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় নির্বাচনপদ্ধতি, সরকারি ক্রয় ও রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এসব ক্ষেত্রে কী কী মানদণ্ড নির্ধারণ করা উচিত?
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: এই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। কে অর্থ দিচ্ছেন, কোথা থেকে সেই অর্থ আসছে, আর কীভাবে তা ব্যয় হচ্ছে—সব জানতে হবে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার স্বার্থে তা শান্তিপূর্ণভাবে, সহিংসমুক্তভাবে, ভয়ভীতি প্রদর্শনমুক্ত হয়ে সাংবাদিক বা নাগরিকদের হেনস্তা ছাড়াই আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, সহিংসতার মাধ্যমে যে ক্ষমতায় আসে, তা স্বচ্ছ ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। আর নির্বাচন শেষ মানেই সংস্কার শেষ নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চলতেই থাকবে।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, শুধু স্বচ্ছতার জন্য নয়; বরং গণতন্ত্রের জন্য। প্রত্যেক নাগরিকের, এমনকি দুর্গম এলাকা বা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা উচিত। ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং ভোট কেনাবেচা বা ভয়ভীতি ছাড়া নির্বাচন হতে হবে। সুতরাং আমাদের কাজ হলো মানুষকে বোঝানো—স্বৈরতন্ত্র নয় গণতন্ত্রই সমাধান। কিন্তু গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়; বরং সচেতন নাগরিকদের অংশগ্রহণও।
রাহীদ এজাজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার: প্রথম আলো