পুঁথি ঘেঁটে সপ্তদশ শতকে রোসাঙ্গরাজের অভিষেক অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়েছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। সেখানে রাজসভার যে ছবি পাওয়া যায়, তাতে দেখি, অভিষিক্ত রাজা সবার সামনে অঙ্গীকার করছেন, তিনি প্রজাদের সন্তানের মতো দেখভাল করবেন, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করবেন না, নিয়ম মেনে রাজ্য চালাবেন, দুর্বলকে সবল করে তুলবেন।
মজলিস পরি দিব্য বস্ত্র আভরণ
সমুখে দাণ্ডাই আগে দঢ়াএ বচন।
পুত্রবৎ প্রজারে পালিবা নিরন্তর
না করিবা ছলবল লোকের উপর।
শাস্ত্র-নীতি রাজকার্যে হৈবা ন্যায়বন্ত
নির্বলীরে বল না করৌক বলবন্ত।
একুশ শতকে এসেও আমরা এমন ছবি দেখি। সরকারপ্রধান ও তাঁর মন্ত্রীরা শপথ নেন। তাঁরা ঘোষণা দিয়ে বলেন, অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবাইকে সমান চোখে দেখবেন, সংবিধান মেনে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, সমাজের অনগ্রসর শ্রেণিকে মূলধারায় আনবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ছবি আমরা দেখি টেলিভিশনে, শুনি তাঁদের মধুর বচন।
তারপর কী হয়? শপথ পাঠের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় শপথভঙ্গের তোড়জোড়। সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যা খুশি তা করার দৌড়। আর দেখি শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালন। বেছে বেছে সন্ত্রাসীদের স্থানীয় সরকারের পদে বসানো, মেম্বার-কাউন্সিলর বানানো। মুখে যা বলেন, কাজ করেন ঠিক তার উল্টো। আমাদের দেশের রাষ্ট্র পরিচালনা আর রাজনীতির ইতিহাস হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে প্রতারণার ইতিহাস। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার শ্লোক আওড়ে বলতে পারি— চুয়ান্ন বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি।
একসময় দেশটা ছিল ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। মাওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেছিলেন, এ দেশের মানুষের চাওয়া খুবই সামান্য, খুব সহজেই তা মেটানো যায়। মানুষ চায় দুবেলা শুধু পেট ভরে ডালভাত খেতে। পাকিস্তান রাষ্ট্র তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি।
একসময় দেশ স্বাধীন হয়। দেখা যায়, দেশে একমাত্র সরকারই স্বাধীন। মানুষ আর স্বাধীন হতে পারল না। সরকার শক্তিমান হলে মানুষ দুর্বল হয়। এ দেশে সেটাই হয়েছে। এখানে সরকার আছে, দল আছে। দল থাকলে দলাদলি থাকে। আর আছে কর্মচারীদের বাহিনী। তারা ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে। নাগরিক শক্তি হয়েছে ক্রমশ হীনবল।
আমরা কথায় কথায় বলি, আমাদের সামরিক বাহিনী সার্বভৌমত্বের প্রতীক, আমাদের জাতীয় সংসদ সার্বভৌম, আমাদের সরকার সার্বভৌম। সার্বভৌমত্ব নেই কেবল জনগণের।
বিশ শতকের শেষ দিকে এসে সভ্য দুনিয়ায় সার্বভৌমত্বের ধারণা পাল্টে গেছে। সেসব দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনগণের সরকার। জনসমাজ যত শক্তিশালী হবে, সরকার আকারে তত ছোট এবং দায়িত্বে তত বড় হবে। আমাদের দেশে সরকারের আকার দিন দিন বাড়ছে, নাগরিক শক্তি ছোট হয়ে আসছে।
সরকার ও তার ধামাধরারা নাগরিক সমাজের একটা ব্যঙ্গাত্মক নাম দিয়েছে—সুশীল সমাজ। সরকারের কর্তারা প্রায়ই বিদ্রূপ করে বলেন, এসব সুশীল-টুশীল দিয়ে কাজ হবে না। পশ্চিমের যে দেশগুলোতে আমাদের কর্তারা তাঁদের সন্তানদের মানুষ করতে পাঠান, সেসব দেশে নাগরিক সমাজকে নিয়ে ট্রল করার স্পর্ধা কেউ দেখান না। কারণ, সেসব দেশে নাগরিকেরাই রাষ্ট্র চালান। সরকারকে চলতে হয় নাগরিকদের মন জুগিয়ে। আমাদের দেশে হয় ঠিক তার উল্টো। এখানে সরকার হচ্ছে নাগরিকদের মালিক, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। মানুষ হয়েছে দাস, তার ট্যাক্সের টাকায় পোষা লোক হয়েছে তার স্যার।
আমরা প্রায়ই একটা কথা শুনে থাকি, রাষ্ট্রের হাত অনেক লম্বা। এখানে রাষ্ট্র মানে তার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা, যেমন সচিবালয়, বিচারালয়, বিভিন্ন বাহিনী। নাগরিকের ট্যাক্সের টাকায় সরকার গোয়েন্দা পোষে। সেই গোয়েন্দার কাজ হলো নাগরিকের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে থাকা —সে কোথায় যায়, কী বলে, কী করে।
একটা দৃশ্য কল্পনা করুন। আপনি আপনার বাড়ি পাহারা দেওয়ার এবং ঘর সাফ রাখার জন্য দারোয়ান কিংবা চাকরবাকর রেখেছেন। আর সেই দারোয়ান কিংবা চাকর আপনার ওপর হম্বিতম্বি করছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে রাষ্ট্র পরিচালনার এই রীতি চালু হয়েছিল। আমরা এখনো সেটি টিকিয়ে রেখেছি। কিন্তু ভণ্ডের মতো আস্তিন গুটিয়ে গলা ফুলিয়ে বলি, আমরা স্বাধীন। এই আমরা কারা?
এ দেশের শাসকদের মধ্যে কয়েকটি সিন্ডিকেট আছে। কিছু আছে পারিবারিক আর কিছু আছে অলিগার্ক। তাদের আছে নানান লোগো, নানান পরিচিতি। একটা বিদায় হলে আরেকটা এসে জোটে। সহজে কি বিদায় হয়? তার জন্য অনেক ঘাম, অনেক রক্ত ঝরাতে হয়।
বিদায় হওয়ার পর পরাজিত পক্ষের মুখে একটাই মন্ত্র উচ্চারিত হয়—আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। তাদের ভাবখানা এমন, সব ঠিকঠাক চলছিল। দেশ শনৈঃশনৈ উন্নতির দিকে এগোচ্ছিল। উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসছিল। মানুষের সুখের সীমা ছিল না।
হঠাৎ একদল লোক বসে ছক কষল—আমাদের এত সুখ সহ্য হচ্ছে না। চলো, আমরা এদের বিদায় করে দিই। তারপর তারা আন্দোলনের নাটক সাজাল, বিদেশিরা ষড়যন্ত্রের জাল বিছাল, জনগণ নির্বোধের মতো তাদের ফাঁদে পা দিল। সরকার বদলে গেল। সিন্ডিকেটগুলো কিছু তোতাপাখি পোষে। তারা দিনের পর দিন এসব মুখস্থ আওড়ে যায়।
এদিকে নতুন যারা মসনদে বসে, কদিন যেতে না যেতেই তারা তাদের সুচালো নখ আর ধারালো দাঁত বের করে। তাদের খবরদারি অতীতের শাসকদেরও ছাড়িয়ে যায়। তখন অতীতচারীরা আওয়াজ তোলে—দেখেছ, আগেই তো ভালো ছিলাম। পিলো পাসিংয়ের মতো এই খেলা চলছে ৫৪ বছর ধরে।
আমাদের ভাষায় ক্ষমতা মানে গদি। আমাদের গদির ওপর লোভ বেশি। ক্ষমতা পেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ক্ষমতা যে দায়িত্ব, এটা বুঝে আসে না।
আমাদের এক নেতা ৫৫ বছর আগে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘চুয়ান্ন সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই’। গদিতে বসার এই অদম্য বাসনা তাদের অস্থি-মজ্জায়, মগজে। একেকটা নির্বাচন আসে, তারা নতুন নতুন ফন্দি হাজির করে। বলে, এবার ক্ষমতায় যেতে পারলে আমরা হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা। দেশটা সোনায় মুড়ে দেব। তারপর কী হয়? ১৯৭০ সালে এক ভরি সোনা পাওয়া যেত ১২০ টাকায়। সেটি এখন প্রায় দুই লাখ টাকা। টাকায় ষোলোটা ডিম পাওয়া যত। এখন ষোলো টাকায় একটা।
বেশ কিছুদিন ধরে নির্বাচনের হাওয়া বইছে। প্রস্তুতি চলছে। শিগগিরই সবাই কোমর বেঁধে নেমে যাবেন। নতুন নতুন ইশতেহার তৈরি হবে। প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভেসে যাবে দেশ, জনপদ। শুধু জিজ্ঞেস করুন, এই প্রতিশ্রুতি কীভাবে, কত দিনে, কত টাকায়, কাকে নিয়ে পূরণ করবেন? কোথায় আপনার সেই রোডম্যাপ?
এর মধ্যে আছে নানান তত্ত্বের তড়পানি, নানান ডিসকোর্সের ডঙ্কা। কেউ চান গণতন্ত্র, কেউ চান বিপ্লব, কেউ চান খিলাফত। একজন আরেকজনেরটা মানেন না। ছোট–বড় দোকান খুলে সবাই ফেরি করছে নিজ নিজ পণ্য— আমার কাছে আছে সর্বরোগের মহৌষধ। আমারটা নিন। এটা এস্তেমাল করলে সব মুশকিল আসান হবে।
তাদের কি বিশ্বাস করা যায়? আজতক কেউ তো কথা রাখেনি!
-
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক।
[৩ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এ লেখা ‘চুয়ান্ন বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।]