১৯৬৮ সালে আমি ছাত্র হিসেবে বুয়েটে পা রাখি। তখন এর নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি। বছর পাঁচেক পর সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তি ঘটে ২০১৬ সালে। মাঝে পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এই দীর্ঘ পথচলার প্রতিটি মোড়ে ছিল আনন্দ, সংগ্রাম, ত্যাগ আর অমূল্য স্মৃতি। তবে বুয়েটে শিক্ষকতার মধ্যে ছুটি নিয়ে কখনো মালয়েশিয়ার মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটি, কখনো সৌদি আরবের দাহরানের কেএফইউপিএম, আবার কখনো যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছি।
পড়াশোনার সময়ই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী বুলবুল প্রায়ই বলত, ‘একদিন দেশ স্বাধীন হবে; তোরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবি, কিন্তু তখন আমাকে আর পাবি না।’
কথাগুলো যেন ভবিষ্যদ্বাণীর মতোই সত্যি হলো। দেশ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হলো, কিন্তু প্রিয় বন্ধুটি আর ফিরে এল না।
এখন ভাবি, দেশের সমস্যাগুলো নিয়েও কাজ করা উচিত ছিল। পরে উপলব্ধি করেছি, গবেষণাই শেষ কথা নয়; শিক্ষকের দায়িত্ব আরও বড়। তাই উচ্চশিক্ষা, পাঠদানপদ্ধতি আর গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি—কীভাবে তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে, সে চিন্তা নিয়েই।
আমার ব্যক্তিগত জীবনেও এই ইতিহাসের ছাপ রয়েছে; সহধর্মিণীর বাবা, শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশীদুল হাসান—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক—তাঁর আত্মত্যাগও সেই ইতিহাসেরই অংশ।
সময় বদলেছে, বুয়েটও বদলেছে। ৬টি স্নাতক প্রোগ্রাম নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান আজ ১২টি স্নাতক প্রোগ্রামে পৌঁছেছে। ছাত্রসংখ্যা বেড়ে ৬৫০ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজারে দাঁড়িয়েছে। তবে গ্র্যাজুয়েট ও পিএইচডি প্রোগ্রাম এখনো তেমন শক্ত ভিত গড়তে পারেনি। শত শত মেধাবী শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও বুয়েট আজও মূলত একটি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই পরিচিত।
প্রশ্ন থেকে যায়, এসব পরিবর্তন কি সমাজের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে? স্লাইড রুল থেকে ক্যালকুলেটর, তারপর কম্পিউটার-প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পাঠদানের ধরন প্রায় অপরিবর্তিত—লেকচারভিত্তিক শিক্ষা আর মুখস্থের ওপর নির্ভরশীল একটি পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন। বুয়েটকেও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।
লিখতে বসলে কিছু টুকরা স্মৃতি ভেসে ওঠে। যেখানে এখন বুয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেখানে ছিল একটি পুরোনো দোতলা ভবন—আমাদের ক্লাব। একদিন এক সিনিয়র স্যার নীরবে নিচতলার কোণে বসে ছিলেন। আমরা তরুণ শিক্ষকেরা লনে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ একজন ফিসফিস করে বলল, ‘স্যার বউয়ের ধমক খেয়ে সকাল সকাল ক্লাবে চলে এসেছেন। ভালোই হয়েছে, ক্লাসে আমাদের কত না জ্বালাতেন!’
চাকরিজীবনে গবেষণায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। পুরস্কারও পেয়েছি—বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল, চারবার ইউজিসি বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড আর আইইবি গোল্ড মেডেল।
চাকরিজীবনে গবেষণায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। পুরস্কারও পেয়েছি—বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল, চারবার ইউজিসি বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড আর আইইবি গোল্ড মেডেল। কিন্তু এখন ভাবি, দেশের সমস্যাগুলো নিয়েও কাজ করা উচিত ছিল। পরে উপলব্ধি করেছি, গবেষণাই শেষ কথা নয়; শিক্ষকের দায়িত্ব আরও বড়। তাই উচ্চশিক্ষা, পাঠদানপদ্ধতি আর গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি—কীভাবে তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে, সে চিন্তা নিয়েই।
করোনার সময়ে ঘরে থেকেই লেখালেখির দিকে ঝুঁকে পড়ি। আমার প্রথম ম্যানুস্ক্রিপ্ট ‘প্রশ্ন’ নিয়ে নিউইয়র্কভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন শিল্পাঙ্গন একটি আলেখ্য তৈরি করে। সেখানে কণ্ঠ দেন নাট্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ আফরোজা বানু। এরপর একে একে তৈরি হয় ‘ছিন্ন পাতা’, ‘পথের শেষ’, ‘নমি তোমারে’, ‘হে ত্যাগী হে গুণী’, ‘ভাবনা’ ইত্যাদি।
নাট্যব্যক্তিত্ব শিরীন বকুল, আবৃত্তিকার লুৎফুন্নাহার প্রমুখও এতে যুক্ত হন। এখন আমি কাজ করছি ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে নতুন আলেখ্য নিয়ে, যেখানে সুপরিচিত নাট্যব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম কয়েকটি পর্বে বর্ণনা করবেন। ঢাকা থেকেই আমি স্ক্রিপ্ট নিউইয়র্কে পাঠিয়ে দিই।
সন্ধ্যার অস্তগামী সূর্য বিদায়ক্ষণে সারা আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে দেয়। সূর্যটা আবার সকালে অন্য রূপে ফিরে আসবে বলে এই ক্ষণিকের তরে হারাতে তার ভালোই লাগে। কিন্তু মানুষের জীবনে ফিরে আসা নেই। তাই পড়ন্ত বেলায় অতীতের স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরি। ভাবি, হয়তো কিছু ভালো করেছি, হয়তো এভাবেই মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়।
-
এম এম শহিদুল হাসান, সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র: প্রথম আলো