সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখেছি—২০২৫ সালের অদ্যাবধি সারা দেশে প্রায় ৫৮০টি এলপিজি সিলিন্ডার দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। সামগ্রিকভাবে গ্যাসের আগুনজনিত দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০।
এসব দুর্ঘটনায় বিভিন্ন স্থাপনায় প্রায় ২০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা সক্রিয়ভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে আনুমানিক ৯৫ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। এ কাজে আমাদের বহু ফায়ার ফাইটার আহত হয়েছেন। তবুও তারা দায়িত্ব ও মানবিকতার পরিচয় দিয়ে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
অতিসম্প্রতি আমরা একটি মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। কেমিক্যাল দুর্ঘটনায় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের তিনজন সাহসী ফায়ার ফাইটার শাহাদাত বরণ করেছেন। এ ঘটনা আমাদের সবাইকে আবারো মনে করিয়ে দিয়েছে, নিরাপত্তা বিষয়ে আরো গভীরভাবে সচেতন হওয়া এখন আর বিকল্প নয়, বরং অপরিহার্য।
এলপিজি একটি দ্রুত বিকাশমান খাত। বাংলাদেশের ভবিষ্যতে এলপিজির ব্যবহার আরো ব্যাপকভাবে বাড়বে। এর ব্যবহার যত বাড়বে, নিরাপত্তা ঝুঁকিও তত বাড়বে। দুর্ঘটনার সংখ্যা হয়তো কমবেশি হবে। এ বাস্তবতা মাথায় রেখে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলা দরকার, বিশেষ করে যারা এলপিজি খাতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত, তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে নিরাপত্তা ও সচেতনতার দিকটি আরো জোরালোভাবে বিবেচনা করা উচিত।
এলপিজির যেসব প্লান্ট ও প্রসেসিং প্লান্ট আছে এবং যারা এলপিজি ব্যবহার করছেন তাদের নিরাপত্তা ও সচেতনতার একটি শক্ত ভিত তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। একটি সিলিন্ডার কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, এর গায়ে থাকা বিভিন্ন চিহ্নের অর্থ কী, কোন অবস্থায় এটি ব্যবহার উপযোগী বা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, এসব সাধারণ জ্ঞান প্রত্যেক ব্যবহারকারীর জানা থাকা উচিত।
একইভাবে কোনো ছোটখাটো সমস্যা দেখা দিলে বা গ্যাসের গন্ধ টের পেলে ব্যবহারকারী প্রাথমিক পর্যায়ে কী ব্যবস্থা নেবেন—এ প্রশিক্ষণটাও তাদের জানা থাকা দরকার। এসব বিষয়ে আমরা গণসচেতনতা বাড়াতে চাই। টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেমন ফেসবুক বা ইউটিউব কিংবা জনসচেতনতামূলক সভা-আলোচনার মাধ্যমে নিয়মিত প্রচার চালানো দরকার। একটি নিরাপদ ও সচেতন এলপিজি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে হলে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে আমরা সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমে আগুন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে একটি পাঠ পরিকল্পনা জমা দিয়েছি। আমাদের প্রত্যাশা, ২০২৬ সালের পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়বস্তুগুলো ছোট ছোট আকারে অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, যদি আমাদের শিশুরা শৈশব থেকেই আগুনসংক্রান্ত মৌলিক জ্ঞান ও সচেতনতা অর্জন করতে পারে, তাহলে তারা ভবিষ্যতে বড় হয়ে দায়িত্বশীল ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। এমনকি ছোট পরিসরে যে আগুনের ঘটনা ঘটে তা সে গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই হোক, বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে হোক কিংবা অন্য যেকোনো উৎস থেকে, সেসব বিষয়ে প্রাথমিক সচেতনতা বাড়াবে এবং শিশুদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করবে। এ কারণেই আমরা চাই, শিক্ষার শুরুতেই আগুন ও নিরাপত্তা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা তৈরি হোক।
একটি বিষয় আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই—প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে আগুনজনিত দুর্ঘটনার হার, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখন আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। বায়ারদের চাপ, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যবসায়ীদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে তাদের নিবিড় ও ধারাবাহিক প্রশিক্ষণমূলক সম্পর্কের কারণেই এ খাতে অগ্নিদুর্ঘটনা কমে এসেছে।
যেহেতু এলপিজি একটি দ্রুত বিকাশমান খাত, এখানে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকবে। এ খাতের সংশ্লিষ্টদের ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত। সারা দেশে আমাদের ৫৩৭টি স্টেশন রয়েছে। ক্রমান্বয়ে এটি বেড়ে ৯৯৭টি স্টেশন হবে। দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে আপনাদের হাতের কাছেই একটি ফায়ার স্টেশন থাকবে।
এ প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারেন অপারেটর, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা। এলপিজি খাতের নির্দিষ্ট ফোকাল পয়েন্টগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় ফায়ার স্টেশনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেই আমরা সর্বদা সহযোগিতায় প্রস্তুত। কারণ আমরা চাই দুর্ঘটনাজনিত আগুনের মাত্রা কমে আসুক এবং প্রতিটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিরাপদ থাকুক।
যখন সিলিন্ডার বা অন্য কোনো ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা কমে আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জানমালের ক্ষতি কমবে এবং অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমরা সবার সহযোগিতা চাই। আমরা যখন প্রচার-প্রচারণা বা সচেতনতা কার্যক্রম চালাব, তখন আমরা আপনাদের পাশে পেতে চাই।
সবশেষে একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমি বলতে চাই, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফাস্ট রেসপন্ডিং অর্গানাইজেশন। যেকোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার মুহূর্তে আমরা প্রথমেই ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। আমাদের জরুরি কল নম্বর ১০২ এবং আমরা সর্বদা প্রস্তুত, সর্বত্র উপস্থিত।
কিন্তু একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, সবাই সাধারণত সেই স্থান থেকে সরে যান। অথচ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই আগুনের কেন্দ্রেই প্রবেশ করেন। তাই সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে আমাদের অনুরোধ, যদি কোনো দুর্ঘটনায় আমাদের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে সরকার যেমন পাশে থাকবে, তেমনি আপনারাও আপনাদের জায়গা থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন। এতে আমাদের কর্মীদের মনে আত্মবিশ্বাস জন্মাবে যে তারা যখন অন্যদের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রাখছেন, তখন এ সমাজও তাদের পাশে থাকবে। এ পারস্পরিক আস্থা ও সহমর্মিতাই আমাদের আগুনের বিরুদ্ধে লড়াইকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে।
- ব্রি. জে. মোহাম্মদ জাহেদ কামাল: মহাপরিচালক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সূত্র: বণিক বার্তা

