অনেকের মতে, দেশের অর্থনীতি সংকটময় পরিস্থিতি পার করছে। কোনোভাবেই যেন এতে স্বস্তি ফেরানো যাচ্ছে না। বিনিয়োগে স্থবিরতা, বেকারত্ব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদের হার ও রপ্তানি-রাজস্বে মন্দা অর্থনীতিকে ভোগাচ্ছে। আস্থাহীনতা অর্থনীতির গতিকে আরো মন্থর করে দিয়েছে।
খোদ সরকারের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে অর্থনীতির নানা দুর্বলতার দিক। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) অক্টোবর মাসের ইকোনমিক আপডেট বলছে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি কমে গেছে, ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে ধীরগতি দেখা দিয়েছে, সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা নতুন উদ্যোগ নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
ফলে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, সরকার বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ নিলেও মূল সমস্যা এখন বিনিয়োগের গতি কমে যাওয়া।
ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। সুদের হার বেড়ে অনেক দিন থেকেই ১৩ থেকে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এতে নতুন কারখানা স্থাপন, প্রযুক্তি সম্প্রসারণ বা ব্যবসা বড় করার আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে।
প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি উন্নত না করতে পারলে, সরকারের অর্থ ব্যয়ে জবাবদিহি না বাড়লে, দুর্নীতি বেড়ে গেলে, প্রয়োজনীয় স্থানীয় অর্থায়ন না বাড়লে সেই আগ্রহে ভাটা পড়তেও সময় লাগবে না।
গত ১০ বছরের মধ্যে এটি অন্যতম সর্বনিম্ন হার। এর আগে এই প্রবৃদ্ধি গড়ে ছিল ১২ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই প্রবৃদ্ধি না বাড়লে কর্মসংস্থান, শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি—সবখানেই প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে ব্যাংকগুলো বর্তমানে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকারি অর্থায়নে। কারণ, সরকার উচ্চ সুদে বড় অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে।
আমরা অনেকেই জানি, সরকার যখন বেশি ঋণ নেয়, তখন সেটিকে ‘বেসরকারি খাতকে ঠেলে দেওয়া’ বা ক্রাউড আউট প্রভাব বলা হয়। এতে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পান না, ফলে বিনিয়োগ কমে যায়।
ব্যবসায়ীরা বারবার বলছেন, উচ্চ সুদের হার আঘাত করছে উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনায়। বর্তমানে ব্যাংকঋণের গড় সুদের হার ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ। অনেক ব্যাংক আবার গোপনে আরও বেশি সুদ নিচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাঁরা বলেন, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারাই বিরাট সাফল্য, নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা।
এমনিতেই ব্যবসায়ীরা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ বেশি সুদ দিয়ে আসছিলেন। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে সেটি আরও বেড়ে গেছে। এখন নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ী সমাজ।
কোথায়, কত টাকা খরচ হবে এবং কতটা মুনাফা হতে পারে, সেটা হিসাব করেই বিনিয়োগ হয়। কিন্তু মাঝপথে যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায়, তখন সব হিসাব ওলট–পালট হয়ে যায়। কারণ, কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মুনাফার হার কমে আসে।
অনেকেই বলছেন, সুদের হার নিয়ন্ত্রণে না আনলে বিনিয়োগে গতি ফেরানো সম্ভব নয়। ব্যাংক খাতে অনিয়ম, খেলাপি ঋণ ও আমানতের কম সুদ—সব মিলিয়ে একটি অস্বাস্থ্যকর আর্থিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, মূল্যস্ফীতি এখনো অসহনীয়। চার মাস ধরে মূল্যস্ফীতি প্রায় একই অবস্থায় রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে। খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমলেও অন্যান্য খাতে ব্যয় বেড়েছে। চাল, মাছ, মাংস ও তেলের দাম এখনো তুলনামূলক বেশি। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ এখনো খাদ্য ও বাসাভাড়ার চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। চালের দাম সামান্য কমলেও মাছ, ফলমূল ও তেলের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
সব সূচকের মধ্যে রপ্তানি আয়ই কিছুটা ভালো অবস্থায় রয়েছে। তবে পত্রপত্রিকার তথ্যমতে, সেটিও গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। বর্তমানে এটি ৩১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। রেমিট্যান্স প্রবাহও বেড়েছে, যা অর্থনীতিকে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে।
ব্যবসায় মন্দার কারণে রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়েছে। প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ঘাটতি রয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সরকারের রাজস্ব আদায়ে ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ভ্যাট আদায় বেড়েছে ৩৪ শতাংশ, আয়কর বেড়েছে ২৪ শতাংশ। শুল্ক আদায় কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ, যা আমদানি হ্রাসের কারণে ঘটেছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আমদানি কমে গেলে শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডেও প্রভাব পড়ে।
রাজস্ব প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে সরকার নতুন কমিশনারেট ও পদ সৃষ্টি করছে। এতে কর আদায় আরও কার্যকর হবে বলে অনেকেরই আশা। তবে আইন প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণই যথেষ্ট নয়; বাস্তবায়নের সাফল্যই মূল।
অনেক ব্যবসায়ী মনে করছেন, শুধু সুদের হার কমালেই হবে না, প্রয়োজন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি সহায়তা ও স্বচ্ছতা থাকলে বিনিয়োগকারীরা আবার সাহস পাবেন। বর্তমানে অনেক উদ্যোক্তা ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
অনেক উন্নয়ন বিশ্লেষকের মতে, দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার পথে ফিরছে, কিন্তু বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সুদের হার নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক খাতে আস্থা পুনরুদ্ধার ও ব্যবসায়িক প্রণোদনা—তিন দিকেই জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একধরনের সতর্ক ভারসাম্যে আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে, রিজার্ভ বাড়ছে, রাজস্ব আদায়ও উন্নতির পথে। কিন্তু বিনিয়োগের গতি না বাড়লে এই স্থিতিশীলতা টিকবে না। বিনিয়োগে স্থবিরতা, ঋণ সংকোচন ও উচ্চ সুদের হার এখন অর্থনীতির প্রধান বাধা। এই তিন সমস্যার সমাধানেই নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা।
হ্যাঁ, একটি ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কিছুটা দৃঢ়তা আসবে, সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজসাধ্য হবে। উন্নয়ন সহযোগীরাও নির্বাচিত নতুন সরকারকে সহায়তা করতে নতুনভাবে এগিয়ে আসবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি উন্নত না করতে পারলে, সরকারের অর্থ ব্যয়ে জবাবদিহি না বাড়লে, দুর্নীতি বেড়ে গেলে, প্রয়োজনীয় স্থানীয় অর্থায়ন না বাড়লে সেই আগ্রহে ভাটা পড়তেও সময় লাগবে না।
- 
মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক। সূত্র: প্রথম আলো 

