বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রাজনীতির পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হিসেবে উঠে আসা প্রসঙ্গ বোধকরি ব্যাংক খাত। কারণ, রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকলেও ব্যাংকের সঙ্গে অনেকাংশে জড়িত তাদের জীবন, জীবিকা ও আয়-ব্যয়।
২০২৪-এর আগস্টে হাসিনা সরকার পতনের পর সংস্কার ইত্যাদির বিষয়ে মানুষের আগ্রহ ফিকে হয়ে এসেছে। তবে ব্যাংক হিসাবধারী কিছু মানুষের কাছে জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে উঠেছে, বিশেষ কয়েকটি ব্যাংক। গণমাধ্যমের কল্যাণে সেসব ব্যাংকের অতীত কীর্তিকলাপ ও বর্তমান অবস্থা দেশের মানুষের কাছে অজানা নেই।
কয়েকটি ব্যাংকে ঘটানো অবিশ্বাস্য কিছু লুটপাটের ঘটনা সিনেমা ও গল্প-উপন্যাসের কাহিনিকেও হার মানিয়েছে। এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা তুলে ধরে মূলধারার পত্রিকাগুলো বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। সেসব প্রতিবেদন কেবল উপেক্ষাই করেনি সরকার, নজিরবিহীনভাবে উচ্চ আদালতের সহায়তায় এ ধরনের কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য অনুসন্ধানও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
সাধারণ পাঠকের স্মৃতিকে উসকে দেওয়ার জন্য এখানে উল্লেখ করা দরকার ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ‘এস আলমের আলাদিনের প্রদীপ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে তথ্যপ্রমাণসহ তুলে ধরা হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদন ছাড়াই এস আলম গ্রুপের মালিকের সিঙ্গাপুরে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার খবর।
প্রতিবেদনটির ভিত্তিতে এই গ্রুপের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু এ আদেশের বিরুদ্ধে এস আলমের করা আপিলের জবাবে হাইকোর্টের রুল খারিজ করে গ্রুপটির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের সব ধরনের অনুসন্ধান চালানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন আপিল বেঞ্চ। তবে কেবল দুদক, বিএফআইইউসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে অনুসন্ধান করতে পারবে বলে উল্লেখ ছিল রায়ে। বলাবাহুল্য, বোধগম্য কারণে সে সময় কেউই এই গ্রুপের বিষয়ে আর কোনো অনুসন্ধান চালানোর সাহস করেনি।
সরকার পতনের পর গ্রুপটির নিজ মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোপাট করা এবং অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা অর্থ অনুসন্ধানে নামে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং অ্যাকাউন্ট জব্দ করাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারপর বিষয়টা আর বাংলাদেশের আদালতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সরকারের পদক্ষেপের কারণে তাদের পরিবারের ব্যবসায় ‘শত শত মিলিয়ন’ ডলার ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন গ্রুপটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। এই গ্রুপ–সম্পর্কিত বিভিন্ন অবিশ্বাস্য বিষয়ের মতো এটিও এক নজিরবিহীন ঘটনা।
পাঠকের জানা আছে, বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে পাঁচটি ব্যাংকের একত্রীকরণ। এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে চারটির মালিকানাই ছিল এস আলম গোষ্ঠীর হাতে, যার কর্মীসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার। এই বিশাল কর্মীবাহিনী পালন করতে চারটি ব্যাংকের বার্ষিক ব্যয় হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মতো। এগুলোর পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্যও দরকার হয় বিশাল অঙ্কের অর্থ। এই ব্যাংকগুলোর কোনোটি গ্রাহকদের ১০ হাজার টাকার চেকও পরিশোধ করতে পারেন না। অথচ তাদের কর্মচারীদের বিশাল অঙ্কের ব্যয় কোথা থেকে মেটানো হচ্ছে, সেটি এক বিস্ময়।

এস আলমের মালিকানাধীন চারটিসহ মোট পাঁচটি ইসলামি ধারার ব্যাংককে একীভূত করার রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলোকে সরকারি মালিকানায় নিয়ে এসে নতুন নাম দেওয়া হবে ইউনাইটেড ইসলামি ব্যাংক। পরবর্তী সময়ে এই ব্যাংককে আবার বেসরকারি মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা কী হবে কিংবা কাকে বা কাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, পাঁচটির মধ্যে চারটি ব্যাংকের মালিক সাইফুল আলম, একটির মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদার। সরকারীকরণ ও পাঁচ বছর পর কোনো এক সময় বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়ায় বহু ধরনের সম্ভাব্য জটিলতার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি এখনো। একীভূত ব্যাংকটি সরকারি মালিকানায় গেলে সেটির কর্মচারীদের বেতন–ভাতা অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সমান করে দেওয়া হবে কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে সমান করে দেওয়াই হবে যৌক্তিক।
ব্যাংকগুলো একত্রীকরণের পক্ষে-বিপক্ষেও রয়েছে নানা মত। আমাদের দেশে ব্যাংক একত্রীকরণের কমপক্ষে দুটি নজির রয়েছে। প্রথমটি হয়েছিল ১৯৭২ সালে, সেবার নয়টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করে গঠিত হয়েছিল চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ও ব্যাংক অব ভাওয়ালপুরকে একীভূত করে সোনালী ব্যাংক, ইউনাইটেড ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংককে সংযুক্ত করে জনতা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংককে একত্র করে অগ্রণী ব্যাংক এবং মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংককে একীভূত করে হয়েছিল গঠিত হয়েছিল রূপালী ব্যাংক।
সেই সঙ্গে বাঙালি মালিকানাধীন দ্য ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনকে জাতীয়করণ করে নাম দেওয়া হয় যথাক্রমে পূবালী ও উত্তরা ব্যাংক। একীভূত করার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত ২০০৯ সালের বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করে গঠিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
১৯৭২ সালের বাস্তবতায় পাকিস্তানি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে একীভূত ও রাষ্ট্রায়ত্ত করার বিকল্প ছিল না, এ কথা ঠিক। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত করার পর ব্যাংকগুলোর বর্তমান স্বাস্থ্যের কারণে পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ২০০৯ সালের একত্রীকরণ নিয়েও। অথচ ব্যাংক কিংবা অন্য যেকোনো ব্যবসা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান একীভূত করা একটি অতি স্বাভাবিক কৌশলগত সিদ্ধান্ত। উন্নত বিশ্বে এটি অহরহই ঘটছে।
প্রশ্ন ওঠে সরকারি মালিকানার দক্ষতা নিয়ে। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে দুটি বাঙালি মালিকানাধীন ব্যাংককে (পূবালী ও উত্তরা) আদি মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ব্যক্তিমালিকানায় ফিরে আসার কারণেই এই দুটি ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় অদক্ষতা ও দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে সফল ও সবল ব্যাংকের তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে, এ কথা বলা যায় নির্দ্বিধায়। বর্তমানে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করে সরকারি মালিকানায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ঘরপোড়া মানুষ তাই সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছে। ভয়টা অমূলকও নয়।
এ ভয়ের সঙ্গে রয়েছে আরেকটা চ্যালেঞ্জ। যে পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করা হবে, সেগুলোর মোট সম্পদ ও ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা, বিপরীতে মোট আমানত ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি এবং খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা।
সংগত কারণে ধরে নেওয়া যায়, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। কারণ, এসব ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে ঋণের প্রকৃত অবস্থা গোপন করে রেখেছিল, ছিল সুশাসনের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। তার ওপর এসব ঋণের একটা বড় অংশ স্বনামে কিংবা বেনামে লুণ্ঠিত হয়েছে স্থূলভাবে। এসব লুণ্ঠিত অর্থকে খেলাপি ঋণ বলার সুযোগ যেমন নেই, তেমনই নেই আদায়ের সম্ভাবনাও। সুতরাং ব্যাংকগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল গহ্বর। একীভূত করা হলে পাঁচটি গহ্বর মিলে তৈরি হবে পাঁচ গুণ বড় একটি গহ্বর। এ বিশাল গহ্বর কীভাবে ভরানো হবে, তার কোনো ইঙ্গিত কিংবা পরিকল্পনা আপাতত নেই।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবিশেষের অপকর্মের কারণে প্রায় ধসে পড়া পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে সরকারি মালিকানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অনন্যোপায় হয়ে। এ প্রক্রিয়ায় মূলধন গঠনের জন্য সরকার তথা জনগণ দেবে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং ১৫ হাজার কোটি টাকা শেয়ারের বিনিময়ে নেওয়া হবে নিরপরাধ আমানতকারীদের কাছ থেকে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর এ অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কোনো জবাবদিহি ও যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা না হলে একীভূত করার এ পরিকল্পনা সাবেক গভর্নরের আমলে জোর করে একীভূত করে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সাবেক মালিকদের দায়মুক্তির মতো ব্যাপারে পরিণত হবে।
-
ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার। সূত্র: প্রথম আলো

