স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাক বদলে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা ওয়ান-ইলেভেনে বিদেশি শক্তির ভূমিকা ছিল কি ছিল না তা নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। তবে সেদিন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠক এবং সমঝোতার চেষ্টার খবর প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় সবগুলো প্রধান দৈনিকে।
সংবাদে বলা হয়, তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় রাজনীতিক-কূটনীতিকরা বৈঠক করেছেন। এছাড়াও সে সময়ের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ‘শান্তির স্বপ্নে: সময়ের স্মৃতিচারণ’ নামে বইতে সে সময়ের বর্ণনা করতে গিয়ে…লিখেছেন সেসময়ে ২০০৭ সারের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনী কার্যক্রমে জাতিসংঘের অসহযোগিতা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর পর্যবেক্ষণে অনীহা এবং সর্বোপরী শান্তিরক্ষী মিশন থেকে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহারের মতো চাপ তৎকালীন রাজনৈতিক সংকটকে আরো ঘণিভুত করেছিলো।
সম্প্রতি গত ৮ মার্চ ঢাকায় সিজিএস আয়োজিত একটি সেমিনারে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপরাষ্ট্রদূত জন এফ ড্যানিলোভিচ ওয়ান ইলেভেনে তাদের সম্পৃক্ততার স্বীকারোক্তি দিয়ে মন্তব্য করেছেন এক এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মার্কিন নীতি ও ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভূমিকা ভুল ছিল।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘তখন আমাদের মনে হয়েছিল, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে। কিন্তু ইতিহাস ভুল প্রমাণ করল। আমাদের ধারণা ভুল ছিল। আমরা দেখলাম ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকল, যার চূড়ান্ত রূপ দেখা গেল ২০২৪ সালের নির্বাচনে।’
পাঠক ওপরের এতগুলো প্রসঙ্গের অবতারণা এ কারণেই করতে হলো যে, এই বিষয়টি স্মরণ করা অতীতে যেকোন রাজনৈতিক সংকটে কূটনীতিকদের ভুমিকা কেমন ছিল। কিভাবে তারা তাদের কতৃত্ববাদী আচরণ বজায় রেখেছিল আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অনৈক্য, অসহিষ্ণুতার সুযোগ নিয়ে। তেমনি ভাবে তাদের দূতিয়ালি লক্ষনীয় ছিল ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এমনকি সামনে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও তাদের বহুমুখী তৎপড়তা চলমান। প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটছে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কূটনীতিকদের যোগাযোগ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজনের সুযোগ নিয়ে এখানে অতীতে বিদেশি কূটনীতিকরা হস্তক্ষেপের সুযোগ নিয়েছেন। আবার অনেকে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী বুঝাতে বা নিজেদের অভিযোগ জানাতেও বিভিন্ন সময়ে বিদেশি কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের অযুহাতে কখনো কখনো পর্দার আঢ়ালে থেকে দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেয়। এর সাথে কৌশলগত বাণিজ্যিক স্বার্থ, তাদের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের গভীর নীল নকশা।
আমরা এখন প্রায় প্রতিদিনই দেখছি বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনের সদস্যরা বিএনপি, জামায়াত ইসলামীসহ গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সাথে ধারাবাহিক সাক্ষাৎ পর্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা জানি, কূটনৈতিকদের আলাপ-আলোচনাগুলো সাধারণত নির্ধারিত ছকে ও এজেন্ডা ভিত্তিক হয়ে থাকে। এটা কূটনৈতিকদের একটা পোষাকী ভদ্র আচরণ। আর ভেতরে ভেতরে থাকে তাদের কলোনিয়াল মাষ্টার মাইন্ড। এই কূটনৈতিক গং ছোট ও দূর্বল অর্থনৈতিক দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিভিন্ন ছবক দিয়ে থাকে। তারা মনে করে ঐসব দেশ বা দেশের রাজনৈতিক দল তথা জনগণ তাদের প্রজা বা গোলাম।
আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই ২০০৭ সালে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের আধা সামরিক ক্যু এর ফসল ছিল পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামল। দীর্ঘদিন ঢাকার মসনদে দিল্লির পদলেহনকারী একটি পাপেট সরকার হিসেবে টিকিয়ে রাখাই ছিল তাদের এজেন্ডা।
দিল্লীর দূতিয়ালি বুদ্ধিতে ঠান্ডা মাথায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দীর্ঘদিন মসনদ থেকে দূরে রেখেছিল। আর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়ার দিল্লীর সাথে কূটনৈতিক কোরাস গান গেয়ে গেছে সকল ভিনদেশী শক্তিশালী রাষ্ট্রসমুহ। জঙ্গি দমনের নামে ভিন্নমত দমনে অনেকের নীরব সমর্থনও ছিল।
বর্তমান বিশ্বে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাধারণত তিন ধরণের সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান।
- জনগণের নির্বাচিত জবাবদিহিমূলক রিপাবলিকান সরকার।
- ফেসিস্ট বা একদলীয় সরকার
- রাজতন্ত্র বা রাজা বাদশাহী সরকার।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নির্বাচনে অনেক সময় ব্যবসায়ীক লোভে, কায়েমী স্বার্থে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করে ফায়দা লুটে। বাণিজ্যিক ও আমলাতান্ত্রিক সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর ফ্যাসিস্ট সরকার বা একক পার্টির ভিত্তিক সরকারের কোন নিয়ম বালাই নেই। সরকারের চরিত্র শুধু তৈল মর্দন করা; খয়ের খা গিরি করা। আর রাজতন্ত্রে বা বাদশাহী শাসনে সরকারে যারা থাকেন, তারা ভালো মানুষ হলে জনগণের উপকার হয়। খারাপ হলে জনগণের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এই তিন ধরনের সরকারেরই কিন্তু কূটনৈতিক বিভাগ থাকে। যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে, মুলত বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
পাশাপাশি নিরাপত্তা মুলক চুক্তি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিনিময় কেন্দ্রীক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। বিনোদন, সফর ও খেলাধূলার বিষয়েও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের পর থেকে দিল্লির নগ্ন কূটনৈতিক থাবায় ঢাকার প্রায় সব সরকারই নাজেহাল ছিল। শুধু শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে দিল্লির মোরারজী দেশাই সরকারের সাথে সমমর্যাদা ভিত্তিক বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে পেড়েছিলেন। আর বিগত ১৫ বছরের শাসনামলতো দিল্লির ফরমায়েশী কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিক বিকিয়ে দিয়েছিল।
অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্র এমনকি প্রভাবশালী অনেক দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে যোজন যোজন দূরে সরে গিয়েছিল আমার প্রিয় বাংলাদেশ। যা দেশের উন্নয়ন অর্তনীতিতে নেতিবাচক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছিল। তবে আশার কথা হলো ২০২৪ এর জুলাই আগস্ট অভ্যূত্থানে আমাদের দেশের ছাত্র জনতা সেই শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিয়েছে। দিল্লীর গোলামির জিঞ্জির ছিড়ে ফেলে ঘোষণা দিয়েছে দুই দেশের সম্পর্ক হবে সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে।
ফ্যাসিস্ট মুক্ত নতুন বাংলাদেশে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকার, অভ্যুত্থানের ফেইস তরুণ নেতৃত্ব ও পুরোনো রাজনৈতিক নেতাদের এমন বক্তব্য ও নৈতিক অবস্থান আমাদের আশান্বিত করে। আবার পর্দার আঢ়ালে চলা নানা তৎপড়তা আমাদের আতঙ্কিতও করে। কলোনীয়াল মাস্টারমাইন্ডদের কূটনৈতিক মারপ্যাচ থেকে আমাদের নতুন বাংলাদেশের নেতারা নিজেদের কতটুকু বাঁচিয়ে চলতে পারবেন। পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করতে গিয়ে কতটা নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষায় কতটা সফল হবেন। তবে আমরা আশাবাদী…।
—লেখক: ফজল মুহাম্মদ, কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক ও ভুরাজনীতি বিশ্লেষক। সূত্র: যুগান্তর

