নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যেখানে অতিপ্রিয় হয়ে ওঠে, সেখানে একদিন অনিবার্যভাবেই কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়। সত্যকে দমন করতে যে শক্তি একসময় বাইরের সমালোচকদের মুখ চেপে ধরেছিল, সেই শক্তিই ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করে নিজেদেরই মানুষদের, বিশেষত বিবেকবানদের।
এমন মুহূর্ত সাধারণত বিস্ফোরণ বা বিদ্রোহের মতো উচ্চস্বরে আসে না। আসে নীরবে, নিঃশব্দে।
ইসরায়েল এখন ঠিক এমন এক সময়ের মুখোমুখি। দেশটির সামরিক প্রধান প্রসিকিউটর ইয়িফাত তোমের-ইরুশালমি গ্রেপ্তার হয়েছেন—অভিযোগ, তিনি এক ফিলিস্তিনি বন্দীর ওপর নির্যাতনের ভিডিও ফাঁস করেছিলেন। এটি কেবল একটি আইনি কেলেঙ্কারি নয়; বরং এক আয়না, যেখানে ইসরায়েল এখন নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
তোমের-ইরুশালমি কোনো বহিরাগত বা শত্রু নন। তিনি ছিলেন ইসরায়েলের সবচেয়ে সুরক্ষিত কেন্দ্রেরই অংশ—সেই আইন ও সামরিক কাঠামোর সদস্য, যা বহুদিন ধরে নিজেকে জাতীয় অস্তিত্বের রক্ষক বলে মনে করেছে। অথচ সেই কাঠামোর ভেতর থেকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন মানবিক অবস্থান, বেছে নিয়েছিলেন সহানুভূতির পথ।
নিষ্ঠুরতার মুখোশ উন্মোচনের সিদ্ধান্ত তাঁর কাছে কোনো বিদ্রোহ ছিল না; ছিল নৈতিক সাহসের প্রকাশ। আর সেই সাহসের কারণেই তাঁকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। তাঁর পরিণতি ইসরায়েলকে সামনে এনে দিয়েছে এক গভীর সত্য—সরকার যখন নিয়ন্ত্রণে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন সততাকেও তারা বিদ্রোহ মনে করে ভয় পেতে শুরু করে।
যে দেশ একসময় বাইরের হুমকিতে কাঁপত, আজ সে দেশ কাঁপছে নিজের অন্তর্নিহিত সত্যের সামনে। যখন সত্যকেই শত্রু মনে করা হয়, তখন জাতির শক্তি ভেতর থেকে ফাঁপা হয়ে যেতে থাকে।
দশকের পর দশক ধরে ‘নিরাপত্তা’ ইসরায়েলের অস্তিত্বের মূল শব্দ ছিল। রাষ্ট্রের শুরুর সময়ে এর মানে ছিল বেঁচে থাকা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি পরিণত হয়েছে এক ধরনের পবিত্র ধারণায়—যার নামে প্রায় সবকিছুকেই বৈধতা দেওয়া যায়। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা হয়ে উঠেছে নিষিদ্ধ কাজ, এমনকি রাষ্ট্রের ভেতর থেকেও।
এই পবিত্রতার ট্র্যাজেডি হলো, এটি এমন এক দেয়াল তৈরি করে যা শুধু সীমান্তের নয়, জাতির বিবেককেও চারদিক থেকে আবদ্ধ করে ফেলে। নিজেদের রক্ষার জন্য যে দেয়াল তোলা হয়, শেষ পর্যন্ত সেই দেয়ালই ভেতরের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি করে।
অযাচিত ক্ষমতা একসময় ভুলে যায়, কাদের রক্ষার জন্য তার সৃষ্টি হয়েছিল। যে সহিংসতাকে একসময় ‘আত্মরক্ষা’ বলা হয়েছিল, সেটি পরিণত হয় অভ্যাসে। তখন ন্যায় রক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই লড়াই করে।
নৈতিক পুনর্জাগরণের শেষ আশ্রয় যারা, সেই সত্যবাদীদেরও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। কারণ তাঁরা নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং ভ্রান্ত ধারণার জন্য হুমকি।
তোমের-ইরুশালমির ঘটনা সেই ট্র্যাজেডির প্রতীক। যে দেশ নিজেদের ওই অঞ্চলের ‘একমাত্র গণতন্ত্রপন্থী’ বলে দাবি করে, সেখানে সহানুভূতি এখন অপরাধে পরিণত হয়েছে। নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ করা হয়ে উঠেছে নির্যাতন করার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক।
অধিকৃত পশ্চিম তীরের জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একসময় যে অস্ত্র তৈরি হয়েছিল, এখন তা ব্যবহার হচ্ছে ভেতরের দিকে। যা আগে ছিল রাজনৈতিক, এখন তা হয়ে উঠেছে মানসিক, সাংস্কৃতিক—এমনকি স্বভাবগতও।
যখন সত্য বলা বিশ্বাসঘাতকতায় পরিণত হয়, তখন সেই ব্যবস্থা আর শৃঙ্খলা রক্ষা করে না; বরং নিজের বিকাশের ক্ষমতাকেই শ্বাসরোধ করে ফেলে।
তোমের-ইরুশালমির গ্রেপ্তারের প্রতিধ্বনি এখন যেন গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থার করিডরে প্রতিফলিত হচ্ছে—যেখানে নীরবতাই আনুগত্য, আর সততাই বিশ্বাসঘাতকতা। সহানুভূতির জায়গা নিয়েছে ভয়, আর ঐক্যের জায়গা নিয়েছে সন্দেহ। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো হারাচ্ছে বৈধতা, মানুষ হারাচ্ছে আস্থা।
এই ক্ষত কেবল রাজনৈতিক নয়, মানবিকও। নাগরিকেরা ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে নিতে শেখেন; কর্মকর্তারা নিজেদের বোঝান তাঁরা কেবল ‘আদেশ মানছেন’; সৈন্যরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে নিষ্ঠুরতাই প্রয়োজন। তখন রক্ষক আর দমনকারীর সীমারেখা মুছে যায়—থেকে যায় এক প্রকার নৈতিক নিদ্রা।
ইসরায়েলের নেতারা এখনো গণতন্ত্রের কথা বলেন, বিশৃঙ্খলার মধ্যেও টিকে থাকার দাবি তোলেন। কিন্তু সেই বক্তব্যগুলো এখন ফাঁপা শোনায়। গণতন্ত্রের স্তম্ভ—বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং তদারকি সংস্থাগুলো—নীরবে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আদালত এখন দুর্বলদের নয়, বরং শক্তিধরদের রক্ষক। সংবাদমাধ্যম দ্বিধাগ্রস্ত, মানবাধিকার সংগঠনগুলো—যারা একসময় দেশের বিবেক ছিল—তাদের করা হয়েছে কোণঠাসা।
শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বিপদ তার সীমান্তের বাইরে নয়, বরং ভেতরে। সহানুভূতি, আস্থা ও বিবেকের অবক্ষয়ই এখন তাদের সবচেয়ে বড় হুমকি। কোনো জাতি যুদ্ধ, একঘরে হয়ে পড়া কিংবা বিশৃঙ্খলার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে, কিন্তু নৈতিক বোধের মৃত্যু ঘটলে কোনো সমাজই টিকে থাকতে পারে না।
যখন সত্য বলা অপরাধে পরিণত হয়, তখন পতন বিস্ফোরণের মতো আসে না; আসে নীরবে—ভয়, নীরবতা ও আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে দিয়ে। তখন হারিয়ে যেতে থাকে সেসব মূল্যবোধ, যেগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে একসময় জাতিটি বিশ্বাস করত।
তোমের-ইরুশালমির গল্প কোনো সাধারণ কেলেঙ্কারি নয়; এটি এক সতর্কবার্তা। এটি দেখায়, যখন একটি জাতি বাইরের দৃষ্টির চেয়ে নিজের ছায়াকেই বেশি ভয় পায়, তখন কী ঘটে। এটি মনে করিয়ে দেয়—ক্ষমতার সবচেয়ে বড় শত্রু বিদ্রোহ নয়, জাগরণ।
কারণ, যে শাসনব্যবস্থা মানবতাকে ভুলে যায়, তার পরিণতি একটাই—একসময় সে নিজের অস্ত্রের লক্ষ্য বানায় নিজেকেই। তখন হারায় কেবল নিয়ন্ত্রণ নয়, হারায় নিজের আত্মাকেও।
- পিটার রজারস কলামিস্ট; মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিবিষয়ক লেখক। সূত্র: মিডল ইস্ট মনিটরের ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

