শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখেছিলেন ১০ টাকায় জনগণকে চাল দেওয়ার এবং ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার। সেই সময়ের চ্যালেঞ্জ এবং দুঃখের স্মৃতি আজও অম্লান। দেশবাসী তখন বলতে বাধ্য হয়েছিল, ‘দশ টাকায় চাউল চাই না, শুধু দুষ্কৃতিদের নিয়ন্ত্রণ করুন।’ অনেক ত্যাগ ও কষ্টের পর সেই সমস্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেও আবার নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ১৩ তারিখ আবার সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ভেতরে দ্রুত বিভেদ এবং অনৈক্য এ সাহসের মূল কারণ।
তারেক রহমান ঘোষণা করেছেন, বিএনপির মূল লক্ষ্য ২০৩৪ সালের মধ্যে একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি’ গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু অতীতের চ্যালেঞ্জ মনে করিয়ে দিচ্ছে, দেশের মানুষ বড় ঘোষণা শোনার আগে সতর্ক থাকে। জনগণ এখনো আতঙ্কিত, তারা চাচ্ছে, আগে রাজনৈতিক অশান্তি কমানো হোক।
কঠিন এই সময়ে বিএনপি মহাসচিব নতুন বার্তা দিয়েছেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, নৌকার ভোটাররা হতাশ হবেন না, ধানের শীষ পাশে আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বার্তা অনেক হিসাবনিকাশের পর দেওয়া হয়েছে। নতুন চার কোটি ভোটারের প্রতিক্রিয়া এবং নির্বাচনের আগে জনজোয়ার সৃষ্টি কেমন হবে, তা এখন গবেষণার বিষয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপির কিছু পদক্ষেপ ঐচ্ছিক হলেও কিছু অনৈচ্ছিক। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের আশ্রয়প্রাপ্ত ও নেতাদের কর্মকাণ্ডের প্রভাব দলের ওপর চাপ ফেলতে পারে। ফলে এসব বক্তব্য দলীয় বিপক্ষে জনজোয়ার তৈরি করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ অনেক ভোটার শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চাইছে এবং অতীতের চাঁদাবাজি ও অলিগার্কদের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতে চায়। তারেক রহমানের ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির লক্ষ্য নিয়ে সতর্ক আশাবাদই নিরাপদ মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান জিডিপি প্রায় ৪৫০-৪৭০ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রায় দুই গুণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দরকার। সঠিক নীতি গ্রহণ করলে এটি ১০-১২ বছরের মধ্যে সম্ভব।
এই অর্জনের জন্য হেভি স্মার্ট কোনো নেতা প্রয়োজন নেই। একটি স্বাভাবিক মানের সরকারও তা করতে পারবে যদি: এক. দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। দুই. সরকারে থাকেন অলিগার্কদের প্রভাবমুক্ত, সৎ ও সাহসী মানুষ। এই দুই শর্ত পূরণ হলে ১০-১২ বছরের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। আজকের কলামে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনা করা হলো। পরবর্তী কলামে সৎ মানুষ ও তাদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা হবে।
স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই আমাদের রাজনীতির মূল রোগ নির্ণয় করতে হবে। স্বাধীনতার পরপরই আওয়ামী লীগের সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স থেকে এই সমস্যা শুরু। আওয়ামী মানসিকতা বিএনপিকে কখনোই সমান প্রতিপক্ষ হিসেবে মেনে নেয়নি। বিশেষ করে শেখ হাসিনা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে ‘৪০০ টাকার মেজর’ হিসেবে ভাবতেন।
আওয়ামী লীগ এবং তাদের রাজনৈতিক মেশিনারিজ সবসময় বিএনপিকে লুক-ডাউন দৃষ্টিতে দেখেছে। সেই কারণে বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখলে আওয়ামী লীগের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যেত। আমরা এ ফল ৫০-৬০ বছর ধরে প্রত্যক্ষ করেছি। এই সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের সুযোগ ইন্ডিয়া নিয়েছে। তার প্রভাব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক বিন্যাসে বিএনপি ও জামায়াত এখন প্রায় একই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। একটি শক্তি আবার রাজনীতিতে ব্রাহ্মণ বনাম নমঃশূদ্র বিভাজন তৈরি করতে চাইছে। কারণ নমঃশূদ্র বলে বিবেচিত দলকে যেকোনোভাবে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা ব্রাহ্মণ শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পুরোনো সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স এবার বিএনপির ওপর প্রভাব ফেলছে।
জামায়াত আজ অনেকটা সেই গরিব স্বজনের মতো, যে একসময় বিএনপির ওপর নির্ভরশীল ছিল, আর এখন নিজের শক্তিতে দাঁড়াতে পারছে। তাই বিএনপির কাছে এই উত্থান সহজে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। জামায়াতের এই অবস্থানকে বিএনপির অনেকেই ‘মোনাফেকি’ হিসেবে দেখছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জামায়াতবিরোধী এই ব্যাখ্যাটি প্রথম দিয়েছিলেন একজন সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী, যিনি তখন বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে জামায়াতও সম্ভবত তাদের পুরোনো ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বিএনপির সামান্য সুপিরিয়রিটি প্রকাশ পেলেই তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই দ্বন্দ্বকে আরও জটিল করে তুলেছে। এখন আসল বিএনপি থেকে গুপ্ত ‘বটলীগ’ আলাদা করা যেমন কঠিন, তেমনি আসল জামায়াত থেকে গুপ্ত ‘বটলীগ’ চিহ্নিত করাও কঠিন। দুই দিক থেকেই বটবাহিনীর সক্রিয়তা স্পষ্ট।
এই পরিস্থিতিতে তারেক রহমান যদি নিজের দল এবং প্রতিপক্ষ—দুই পক্ষ থেকেই এসব রোগ দূর করতে পারেন, তবে হাফ ট্রিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে পৌঁছানো সম্ভব। এজন্য মিঠা ওষুধের চেয়ে তিতা ওষুধই কার্যকর হতে পারে। কারণ জাতি হিসেবে আমরা বরাবরই একটু পাহলোয়ান স্বভাবের। নেতা ‘ধইরা আনতে’ বললে আমরা ‘বাইধা’ আনতে চেষ্টা করি। যাদের মগজে অতিরিক্ত ‘চেতনা’ ঢুকে গেছে, তাদের ডিচেতনাইজ করা না গেলে জাতির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। এই মানসিকতা নিয়েই ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গড়া সম্ভব নয়। যেমন খণ্ডিত জাহাজ সাগর পাড়ি দিতে পারে না, তেমনি খণ্ডিত জাতি নিয়েও দূর যাওয়া যায় না।
মাফিয়া রানির অর্থমন্ত্রী ৪ হাজার কোটি টাকার লুটপাটের কথা যে রাতে ঘোষণা করেছিলেন, সেই রাতেও কয়েক কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত পেটে ঘুমিয়েছিল। মাফিয়া রানি নিজের এক পিয়নের ৪০০ কোটি টাকার লুটকে গর্বের সঙ্গে জানাচ্ছিলেন। হাদিসে বলা আছে, ‘তুমি পেট পুড়ে খেলে অথচ প্রতিবেশী না খেয়ে রাত কাটাল, তাহলে তুমি মুসলমান নও।’ অনেকেই ভাবতে পারেন, ধনী এলাকায় থাকায় এই হাদিস আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এই দায় শুধু প্রতিবেশীর জন্য নয়, আধুনিক রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য।
মাফিয়া রানি ও তার অলিগার্করা ২৫০ বিলিয়ন ডলার বা ৩০ লাখ কোটি টাকা লুট করেছেন। এই অর্থ দিয়ে দেশের ছয় কোটি যুবককে প্রত্যেককে ৫ লাখ টাকা দিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা বা ফার্ম তৈরি করলে দেশে আর ক্ষুধার্ত মানুষ থাকত না। তাই এদেশের কয়েক কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত পেটে ঘুমোতে যাচ্ছে, তার দায় আমাদের সকলের ওপর বর্তায়।
লুটপাটের সময় দেশে টাকার অভাব ছিল না। হাজার কোটি টাকার অঙ্ক সেখানে কম ছিল না। অথচ শিক্ষক সমাজ সামান্য বেতন বৃদ্ধি চেয়ে মাফিয়া রানির আমলে মরিচ-পানির স্প্রে খেয়েছেন। বর্তমান আমলেও জলের ধাওয়া ও পুলিশের লাঠিপেটা ভোগ করেছেন। আর রাজনীতির আলাল ও দুলালরা অর্ধশতাব্দী পরও সেই চেতনার প্রভাব থেকে মুক্ত হননি।
কিছু নেতানেত্রী এখনও চৈত্র মাসের ওয়াজ বা শীতকালে করা কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। কেন এমন করছেন, তা বোঝা কঠিন। তুলনামূলকভাবে, আমেরিকাতেও স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছিল। ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগী অনেক রাজাকারও ছিল। কিন্তু আমেরিকার জনগণ তাদের প্রতি ঘৃণা জিইয়ে রাখেনি। জাপানও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আণবিক বোমা মারার ক্ষোভ দীর্ঘমেয়াদি রাখেনি। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা সামনের প্রজন্মের জন্য দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আমরা জাপান ও আমেরিকার মতো ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দিকে এগোব, নাকি আফ্রিকার অনেক দেশের মতো ঘৃণার দোলাচলে যুগের পর যুগ আটকে থাকব—তা নির্ভর করবে আমাদের সমষ্টিগত হুঁশের ওপর। আফ্রিকার বহু দেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। কিন্তু তারা এগোতে পারছে না। কারণ তাদের ভেতরেও আমাদের মতো ভয়ংকর ‘চেতনা’ সক্রিয়। সেই চেতনার প্রধান উপাদান ঘৃণা, ঘৃণা এবং ঘৃণা। তারা ঘৃণার এই চক্র ভাঙতে পারছে না। কলোনিয়াল শক্তিরা এখনও আড়াল থেকে এই বিভাজনকে উসকে দেয়।
এক সহকর্মী বর্তমানে অ্যাঙ্গোলায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। এক বন্ধু দেশটির অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যদি আরও পাঁচ-ছয় বছর ক্ষমতায় থাকতেন, বাংলাদেশ যেখানে পৌঁছাত, অ্যাঙ্গোলা এখন অনেকটা সেখানেই আছে। অথচ দেশটিতে বিলিয়ন ডলারের প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা এখনও আগের কলোনিয়াল শক্তি শুষে নিচ্ছে। একসময় গ্রামাঞ্চলে জেয়াফতের দাওয়াতে কলাপাতা ওয়ানটাইম প্লেটের মতো ব্যবহার হতো। তখন এক সম্প্রদায় কলাপাতার একদিকে খেত, অন্য সম্প্রদায় উল্টো দিকে। মনে পড়ে, এমন এক জেয়াফতে এক মুরব্বি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “এই ব্যাটা! উল্টো করে খা, এই পিঠে হিন্দুরা খায়!”
জুলাইয়ের আগে আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি ছিল এমন মানসিক অবস্থায়। এখন বিএনপি ও জামায়াতকে একই ফেনোমেনায় দাঁড় করানো হয়েছে। একজন যা বলবে অন্যজন তার উল্টোটা বলবেই। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, তারা আর জাতিকে সোজা পথে হাঁটতে দেবে না। এই অচলায়তন ভাঙার সুযোগ এখন তারেক রহমানের সামনে। তিনি সত্যিই দেশকে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে নিতে চাইলে তাকে একজন রাজনীতিকের ভূমিকা ছাড়িয়ে স্টেটসম্যান হিসেবে উঠতে হবে। একজন রাজনীতিক হিসেবে তিনি সহজেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের দলকে ক্ষমতায় নিতে পারেন। কিন্তু একজন স্টেটসম্যান হিসেবে তিনি পুরো জাতিকে একত্র করতে পারেন এবং আগামী কয়েকশ বছরের জন্য দেশকে নতুন দিশা দেখাতে পারেন।
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম সুযোগটি পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিরোধী শক্তির ওপর লাল ঘোড়া চেপে দাবড়ানোর চেষ্টা করে সেই সুযোগ নষ্ট করেন। উল্লেখ্য, এই লাল ঘোড়া তিনি একসময়ের রাজনৈতিক সতীর্থদের ওপর দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সুযোগটি পেয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি তা সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করেছিলেন। শহীদ জিয়া জনগণের মনকে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি কখনোই জনগণের কাছে দুর্বোধ্য বা দূরের মতো মনে হননি। সংখ্যাগরিষ্ঠের বোধকে চেতনার ভেতর দিয়ে চাপা দেওয়া শুরু হলে, তিনি জাতিকে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন।
শহীদ জিয়া জনগণকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক নিরাপত্তা দিয়েছেন। এর বিনিময়ে তিনি জনগণের পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন। তাই সংবিধানের শুরুতে তিনি বিসমিল্লাহ সংযুক্ত করে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করলেও তার বেশি ধর্মাভিনয় করতে হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মন জয় করে তিনি দুর্বার গতিতে দেশকে এগিয়ে নেন। তখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচক দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
একইভাবে লি কুয়ান ইউ ও মাহাথির মুহাম্মদও জনগণের আস্থা শতভাগ উপভোগ করেছিলেন। তারেক রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে জনগণের পালস বুঝতে হবে। চেতনার চোরাবালিতে ডুবে গেলে সব পরিকল্পনা আগের মতোই ব্যর্থ হবে। তখন ট্রিলিয়ন ডলারের স্বপ্নও আকাশে উড়ে যাবে এবং ‘কল্পনা’ ঘাসের ওপর গড়াগড়ি খাবে।

