পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রান্তিক দরিদ্র মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে। সম্পূর্ণ দেশীয় ধারণার ওপর ভিত্তি করে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটি এত অল্প সময়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার নজির স্থাপন করেছে।
একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক গঠন তার ভবিষ্যৎ পথচলার দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোন পথে অগ্রসর হবে, কার্যক্রম বাস্তবায়ন কৌশল কী হবে, সমাজে কী প্রভাব ফেলবে—সবই নির্ভর করে প্রতিষ্ঠার শুরুয়ের কাঠামোর ওপর। পিকেএসএফের ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট। নব্বইয়ের দশকে গঠনের সময় বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখলেও, পিকেএসএফের কাঠামোতে এর অযাচিত প্রভাব এড়িয়ে যাওয়াই সম্ভব হয়েছিল। সেই সুফল আজকের বাংলাদেশে পিকেএসএফকে এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সেই সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রায় সব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার প্রভাব খুব বেশি ছিল। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম প্রায়শই এই সংস্থাগুলোর সিদ্ধান্ত এবং আশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সরকারি ব্যবস্থাপনা নেটওয়ার্ক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পরিষেবা পৌঁছে দিতে সবসময় কার্যকর ছিল না।
এই বাস্তবতায় সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের বাইরে থেকে দরিদ্রদের কাছে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে পিকেএসএফ গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর ফাউন্ডেশনটি শুধুমাত্র সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না, বরং দাতা সংস্থার সরাসরি প্রভাব থেকেও স্বাধীন থাকতে পেরেছিল। প্রাথমিক পথচলায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চ শিক্ষিত ও দূরদর্শী ব্যক্তিদের বিচক্ষণতা, কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং দেশপ্রেমই পিকেএসএফকে স্বাধীনভাবে পরিচালনার সুযোগ দিয়েছে। এই কারণেই আজ পিকেএসএফ বাংলাদেশের সমাজকল্যাণ খাতে একটি শক্তিশালী ও ইতিবাচক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত।
প্রাথমিক পর্যায়ে পিকেএসএফ গ্রামীণ অঞ্চলে আত্মকর্মসংস্থান এবং মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নগদ অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। পরে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা, প্রযুক্তি স্থানান্তর, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ এবং মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ফাউন্ডেশন তার সম্প্রসারিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অবদান রাখতে শুরু করে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ওস্তাদ-শাগরেদ সম্পর্কের মাধ্যমে কারিগরি দক্ষতার সম্প্রসারণ। মোটর ড্রাইভিং, মেকানিক্স, হস্তশিল্প, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি শিল্পে নবনিযুক্ত শ্রমিকরা শাগরেদ হিসেবে অভিজ্ঞ ওস্তাদদের কাছ থেকে হাতে-কলমে কাজ শিখে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পেশাদার গাড়িচালকদের প্রায় সবাই বাস্তব কর্মক্ষেত্রে তাদের ওস্তাদের কাছ থেকেই ড্রাইভিংয়ের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।
শুধু ড্রাইভিং নয়, কারিগরি দক্ষতাভিত্তিক বহু পেশায়ও শাগরেদ হিসেবে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নবাগতরা নিজেকে গড়ে তোলে। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর তারা নিজেও নতুন শাগরেদের শিক্ষক হয়ে যান। সমাজে এই প্রক্রিয়ার শতসহস্র উদাহরণ আছে।
সম্প্রতি পিকেএসএফ এই প্রথাগত ওস্তাদ-শাগরেদ সংস্কৃতিকে কাজে লাগিয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির প্রসার নিশ্চিত করা হয়েছে। সম্প্রতি পিকেএসএফ অরবিস ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যৌথভাবে ১০ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষের চক্ষু চিকিৎসা এবং ১ লাখ ছানি অপারেশন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি ফাউন্ডেশনের গত সাড়ে তিন দশকের বহু মানবিক কর্মকাণ্ডের একটি উদাহরণ মাত্র।
পিকেএসএফ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কারিগরি সেবা প্রদান, আধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তর, উৎপাদিত পণ্যের বিপণন সহায়তা এবং আর্থিক পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং খরাপ্রবণ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায়ও ফাউন্ডেশন বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোর জন্য উন্নত ও টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
দেশের ৩০টি জেলায় ১৮২টি উপজেলায় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১২ হাজার তরুণকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে ৩০% নারী। এছাড়া, অতিদরিদ্রদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলধারায় যুক্ত করার জন্য পিকেএসএফের বিশেষ কর্মসূচি রয়েছে। আবাসন, কৃষি, ক্ষুদ্র উদ্যোগ, পরিবেশ ও জলবায়ু, লাইভস্টক, ঝুঁকি নিরসন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের জন্য পৃথক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সম্প্রতি পিকেএসএফ পাঁচ বছরের কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এর লক্ষ্য নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি, আয় ও সম্পদ সংরক্ষণ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও সহযোগী সংস্থাসহ নিজের সামর্থ্য বৃদ্ধিকরণ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিকেএসএফ মাঠপর্যায়ের সব কার্যক্রম সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে আসছে। কোনো কার্যক্রম সরাসরি মাঠে চালানো হয় না। এই সৃজনশীল পদ্ধতির ফলে গত সাড়ে তিন দশকে প্রায় ২০০টি সহযোগী সংস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পিকেএসএফ তাদের স্বচ্ছতা, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, নীতিকাঠামো এবং মাঠে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। সহযোগী সংস্থাগুলোর মধ্যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক স্তরেও পরিচিতি ও সুখ্যাতি অর্জন করেছে। ফলে, পিকেএসএফ বহু উন্নয়ন সংস্থার গঠনেও ভূমিকা রেখেছে।
প্রায় সাড়ে তিন দশকের পথচলায়, পিকেএসএফের সাফল্যের প্রতিটি ধাপে যারা অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভক্ষণে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানানো হলো।

