গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার রায় গত সোমবার (১৭ নভেম্বর) ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
রায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। স্বীয় দোষ স্বীকারকারী রাজসাক্ষীরূপে বাংলাদেশ পুলিশের প্রাক্তন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আদালতের অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচটি অপরাধ। এর মধ্যে প্রধান হলো—উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া, ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা, রংপুরের আবু সাঈদ এবং ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা, আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেওয়া।
শেখ হাসিনাকে দ্বিতীয় অভিযোগসহ মোট তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আসাদুজ্জামান খান কামাল দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল সর্বোচ্চ সাজার পাশাপাশি দেশের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দের নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকারকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে দেশে গণআন্দোলনের সময় পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর নৃশংসতা সর্বজনবিদিত। আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগী সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীর সহিংসতা লক্ষ্যণীয়। তবে সরকারি বাহিনী এবং দলের নেতাদের নৃশংসতা থামাতে বিশেষত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা ছিল না।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনও জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অভিযুক্তরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নৃশংসতা রোধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ঘটনার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ট্রাইব্যুনালও রায়ে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। শহীদ পরিবার এবং গণআন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত বা স্থায়ীভাবে অক্ষম হওয়া সহস্র মানুষদের জন্য এই রায় কিছুটা হলেও উপশমের কারণ হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এই রায় প্রমাণ করল, ক্ষমতার অবস্থান যাই হোক, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নেই।
আলোচ্য মামলা এবং রায়ের প্রসঙ্গে সচেতন নাগরিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার নানা প্রশ্ন ও পরামর্শও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য ২০১৩ সালে আবুল কালাম আজাদের (বাচ্চু) অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বিচার তুলনায় শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া উত্তম ছিল না।
বার্গম্যানের মতে, আসামিপক্ষের আইনজীবী রাষ্ট্রের বক্তব্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ গ্রহণ করেননি। রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতা সত্ত্বেও আসামিপক্ষ যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ না করায় বিচার প্রক্রিয়া সব দিক থেকে সম্যক হয়নি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত সকল হত্যা ও নৃশংসতায় জড়িতদের উপযুক্ত বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন—এমন দাবি এখন আরও জোরালো। আন্দোলনে যে বিপুল প্রাণহানি ও রক্ত ঝরেছিল, তা কোনোভাবেই বৃথা যেতে দেওয়া যায় না। এ কারণে বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও আইনানুগ হওয়া জরুরি। শাস্তি ঘোষণার আগ পর্যন্ত প্রতিটি অভিযুক্ত ও আসামির আইনি অধিকার নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এই নিশ্চয়তা অপরিহার্য।
জনগণের প্রত্যাশা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এমন একটি ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না। কারণ গণতন্ত্র, সুশাসন ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার জন্যই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এই জাতিকে দিতে হয়েছিল বড় ধরনের আত্মত্যাগ। সূত্র: সমকাল

