বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৈরি হওয়া উন্নয়নের ধারা মূলত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলার তিনটি গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রয়োগ হয়েছে।
গত শনিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৫’ সম্মেলনের প্রথম দিনে দেবপ্রিয় এই মন্তব্য করেন। তিনি একক বক্তৃতা দেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আয়োজন করা এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন দেশের চিন্তাবিদ, রাজনীতিক, কূটনীতিক ও গণমাধ্যমের ব্যক্তিত্ব। সিজিএস জানিয়েছে, ৮৫টি দেশের ২০০ বক্তা, ৩০০ প্রতিনিধি ও এক হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারী এতে যোগ দেবেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “গত দেড় দশকে ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিকদের একটি বলয় গড়ে উঠেছিল। ব্যাংক, বিদ্যুৎসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল তাদের হাতে। এই গোষ্ঠীগুলো প্রতিযোগিতা এড়িয়ে গেছে। ফলে শুধু স্বজনতোষী পুঁজিবাদ নয়, দেশের মধ্যে চৌর্যতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “সংস্কারের পরিকল্পনা করা সহজ, কিন্তু বাস্তবায়ন সবচেয়ে কঠিন। সংস্কার সরকারের হাত দিয়ে শুরু হয় না, সরকারের হাত দিয়েই শেষও হয় না। দেশ, মানুষ ও অংশগ্রহণকারীর ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এটি সম্ভব। গতি বজায় রাখা এবং আলস্য দূরে রাখা সবচেয়ে জরুরি। বাংলাদেশ এখন ঠিক এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”
দেবপ্রিয় সাম্প্রতিক কাজের আলোকে বাংলাদেশের সংস্কারের অভিজ্ঞতাকে ‘সংস্কারের সঙ্গে রোমান্স’ হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি ৪০ বছর আগের চলচ্চিত্র ‘রোমান্সিং দ্য স্টোন’ এর উদাহরণ দেন। সেখানে অ্যাডভেঞ্চার, রোমান্স ও কমেডির সমন্বয় গল্পটিকে আনন্দদায়ক করে। বাংলাদেশে সংস্কারের প্রক্রিয়াকেও তিনটি উপাদানের সমন্বয় হিসেবে দেখা যায়। তিনি বলেন, “আমাদের তিনটি মূল লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন। এর মধ্যে সংস্কারই মূল। অন্য দুটি লক্ষ্যকে সংযুক্ত করে সংস্কার। এতে জাতি গঠনে অগ্রগতি বাধ্যতামূলক, পিছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই।” অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্র প্রতিবেদনের কাজেও নেতৃত্ব দিয়েছেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, “গত দেড় দশকে দেশে উন্নয়ন মানেই কৌশল ও কর্ম সম্পাদন বোঝানো হয়েছে। এর ফলে উন্নয়নের ধারণা সংকীর্ণ হয়েছে।”
দেশ এখন নতুন রাজনৈতিক সমাধানের খোঁজে। দেবপ্রিয় বলেন, “প্রশ্ন হলো কীভাবে প্রতিযোগিতা-বিরোধী জোট ভাঙা যায়। রাজনৈতিক হোক বা অর্থনৈতিক, তারা প্রতিযোগিতা চায় না। এর উত্তর হলো সংস্কার। সংস্কারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সমাধান, নতুন চাহিদা পূরণ, কার্যকারিতা বৃদ্ধি, সঠিক সম্পদ বরাদ্দ ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে এটি রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের জন্য সবচেয়ে বড় ধাঁধা।” তিনি উল্লেখ করেন, “সংস্কারের গাইডবুক নেই। প্রায়োগিক অর্থনৈতিক নীতি জটিল। তাই সংস্কার প্রক্রিয়া শক্তিশালী, সুসংগত ও বাস্তবসম্মত হতে হবে। প্রতিটি দেশকে নিজস্ব পথ খুঁজতে হবে।”
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কয়েকটি শিক্ষা দিয়েছেন। সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী বা দুর্বল রাষ্ট্র থাকা বাধ্যতামূলক নয়। পরিবর্তনের সময় সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। মূল চাবিকাঠি হলো দূরদৃষ্টি, পরিকল্পনা, সমন্বয় ও ফলাফলের স্বচ্ছতা। এতে রাজনৈতিক সংযোগ ও নাগরিকদের অংশগ্রহণ অবশ্যক।

