সারা বিশ্বই গবেষণা ও উদ্ভাবনে উৎকর্ষ অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতা করছে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হয়। গবেষণা হলো যেকোনো দেশে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সফলতা অর্জন ও উদ্ভাবন ঘটানোর প্রধান মাধ্যম। পেশাদার জার্নালগুলো হলো সেই প্লাটফর্ম যেখানে গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন তথ্য, তত্ত্ব, উদ্ভাবন ও জ্ঞান প্রকাশ করা হয়।
প্রতিটি বিষয়ে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/দেশ থেকে অনেক জার্নাল প্রকাশিত হয়। সর্বোচ্চ মানের জার্নাল হলো কিউ১ (কোয়ারটাইল-১) জার্নাল, যা কিউ২, কিউ৩ বা কিউ৪ জার্নালের তুলনায় অনেক উন্নত মানের। কিউ১ জার্নালগুলো সব র্যাংককৃত জার্নালের ওপরের ২৫ শতাংশের মধ্যে থাকে।
এক বিশ্বস্ত সূত্র অনুযায়ী ২০২৫ সালের হিসাবে বিশ্বে প্রায় ৪৭ হাজার সক্রিয় একাডেমিক জার্নাল রয়েছে। স্কোপাসের তালিকা অনুযায়ী এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার ৭১৪ কিউ১ জার্নাল।
সাধারণভাবে শীর্ষ বিজ্ঞানী বা গবেষকরা তাদের গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক উচ্চপ্রভাবশালী জার্নালে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন, যাতে সর্বাধিক পাঠক আকৃষ্ট হয়। জার্নালের র্যাংকিং নির্ভর করে তার সাইটেশনের ওপর। সাইটেশন জার্নালের প্রভাব ও গুরুত্ব পরিমাপ করে। বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম রয়েছে, যা সাইটেশন ডাটার ভিত্তিতে বিভিন্ন জার্নাল মেট্রিক্স তৈরি করে মান নির্ণয় করে।
আর্টিকেল সাইটেশন ও জার্নাল সাইটেশন-
যদি কোনো লেখক অন্য লেখকের প্রকাশিত রেকর্ড (সাধারণত জার্নাল আর্টিকেল) তার প্রকাশিত আর্টিকেল বা রেকর্ডে রেফারেন্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাহলে রেফারেন্সকৃত লেখক একটি সাইটেশন পায়।
সাইটেশন হলো তথ্য, ধারণা বা গবেষণার উৎসকে স্বীকৃতি দেয়ার আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি। কোনো প্রকাশিত আর্টিকেলের সাইটেশন সংখ্যা তার প্রভাব বা প্রয়োগযোগ্যতা নির্দেশ করে। কোনো গবেষকের সব প্রকাশনার মোট সাইটেশন সংখ্যা তার বৈজ্ঞানিক অবদানের কার্যকারিতা নির্দেশ করে।
একইভাবে জার্নাল সাইটেশন ঘটে যখন কোনো জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেলকে অন্য লেখকরা তাদের আর্টিকেলে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে। এটি প্রকাশিত গবেষণার আনুষ্ঠানিক রেফারেন্স।
এইচ-ইনডেক্স-
২০০৫ সালে আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ হিরশ গবেষক ও বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত কাজের অবদান পরিমাপের জন্য এইচ-ইনডেক্স প্রস্তাব করেন। এটি হলো একটি মেট্রিক যা গবেষক বা জার্নালের প্রকাশিত কাজের উৎপাদনশীলতা ও প্রভাব একসঙ্গে পরিমাপ করে। একজন গবেষকের উৎপাদনশীলতা নির্ধারিত হয় তার প্রকাশিত আর্টিকেলের মোট সংখ্যা দ্বারা। আর প্রভাব বা প্রভাবশালিতা নির্ধারিত হয় কতবার সেই প্রকাশনাগুলো অন্য গবেষকদের দ্বারা উদ্ধৃত হয়েছে তার মাধ্যমে।
উদাহরণ: কোনো গবেষকের এইচ-ইনডেক্স কে হলে তার অর্থ হচ্ছে তিনি কমপক্ষে কে-টি প্রকাশনা করেছেন, যার প্রতিটি কমপক্ষে ‘কে’ বার অন্যের গবেষণাপত্রে উদ্ধৃত হয়েছে। বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য উচ্চ এইচ-ইনডেক্স অত্যন্ত জরুরি।
জার্নালের প্রভাব পরিমাপ-
ওয়েব অব সায়েন্স (ডব্লিউওএস) সৃষ্ট ক্ল্যারিভেটের জার্নাল সাইটেশন রিপোর্ট (জেসিআর) হলো জার্নালের গুণমান এবং প্রভাব নির্ধারণের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অনলাইন প্লাটফর্ম। আর কোনো গবেষক, প্রতিষ্ঠান বা দেশের জার্নাল সাইটেশন রিপোর্ট খুঁজে পাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন প্লাটফর্ম হলো স্কিমাগো।
Elsevier প্রকাশন সংস্থা স্কিমাগো তৈরি করেছে, যা স্কোপাস ডাটাবেজ ব্যবহার করে জার্নাল এবং দেশের রÅvংকিং নির্ধারণ করে। সায়েন্স জার্নাল রÅvংক (এসজেআর) হলো জার্নালের মান পরিমাপের একটি সূচক, যা স্কোপাসে প্রকাশনা ও সাইটেশন ডাটার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
স্কিমাগো স্কোপাসে সূচিকৃত জার্নাল বিশ্লেষণ করে এবং ওই ডাটাবেজের প্রত্যেক জার্নালকে একটি এসজেআর ইন্ডিকেটর দেয়, যা জার্নাল ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরের (জেআইএফ) মতো কিন্তু সাইটেশন মান অনুযায়ী সমন্বয় করা।
জার্নাল ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর (জেআইএফ) হলো গত দুই বছরে প্রকাশিত আর্টিকেলগুলোর প্রতি বছরের গড় সাইটেশন সংখ্যা।
কোন জার্নালের Source Normalized Impact per Paper (SNIP) গণনা করা হয় ওই জার্নালের বর্তমান বছরের সাইটেশন সংখ্যাকে গত তিন বছরে নির্দিষ্ট একটি ফিল্ডে প্রকাশিত আর্টিকেলের মোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে।
অতীতকালে বিভিন্ন বিষয় বা ফিল্ডের পেশাগত সোসাইটি বা অ্যাসোসিয়েশন নিজেদের ডিসিপ্লিনে বা বিষয়ে জার্নাল প্রকাশনা ও ব্যবস্থাপনা করত। সম্প্রতি অনেক ভালো মানের জার্নাল বাণিজ্যিক প্রকাশনা কোম্পানিগুলো কিনে নিয়েছে, বেশি লাভ করার জন্য। কোম্পানিগুলো গবেষকদের কাছ থেকে বিশাল অংকের পাবলিকেশন ফি আদায় করে। তারা বিশ্বব্যাপী মার্কেটিং করে তাদের জার্নালের সাইটেশন ও মান বাড়ায়। পেশাগত জার্নালের এ বাণিজ্যিকীকরণ প্রকাশনার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অর্থের জন্য নিম্ন মানের আর্টিকেলও প্রকাশ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রকাশিত জার্নালের মান-
বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত জার্নালগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের। বাংলাদেশের তিনটি শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত জার্নালগুলো তাদের জার্নালের মান উন্নত করার জন্য গুরুত্ব সহকারে চেষ্টা করছে।
এর মধ্যে রয়েছে—
১. বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বুলেটিন, ২. জার্নাল অব বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস (বিএএস) এবং ৩. বিএমইউ কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ) জার্নাল। বিশ্বব্যাপী গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য স্কিমাগো এবং ক্ল্যারিভেট ডাটাবেজ দ্বারা তাদের সবাইকে তালিকাভুক্ত/সূচক করা উচিত।
একটি সূত্র অনুযায়ী জার্নাল অব হেলথ, পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন (জেএইচপিএন) হলো আইসিডিডিআর,বি কর্তৃক প্রকাশিত। তবে স্কিমাগো রিপোর্ট অনুযায়ী এটি ইউকে-ভিত্তিক বায়োমেড সেন্ট্রাল লি. থেকে প্রকাশিত।
বাংলাদেশের প্রকাশিত নিম্নমানের জার্নাল-
বাংলাদেশের অনেক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক জার্নাল প্রকাশ করে। এদের প্রায় সবই এতটা নগণ্য যে স্কিমাগোতে কোনো উল্লেখই নেই। অনেক ক্ষেত্রে এগুলোই বাংলাদেশে একাডেমিক পদোন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়। দুঃখজনকভাবে এ জার্নালগুলো জার্নাল রÅvংকিং এজেন্সি দ্বারা স্বীকৃত নয় এবং এতে প্রকাশিত আর্টিকেল সাধারণত কোনো সাইটেশন পায় না।
কিছু শিক্ষাবিদ মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল প্রকাশনা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে, অথচ প্রকৃতপক্ষে এগুলোর স্বপ্রচারের বাইরে কোনো কৃতিত্ব নেই। একাডেমিক পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ জার্নালগুলোকে কৃতিত্ব দেয়া উচিত নয়।
এ দেশের গবেষকরা তাদের গবেষণার ফলাফল অস্বীকৃত জার্নালে প্রকাশ করে মেধার অপচয় করছেন, যা বাংলাদেশের গবেষণা ব্যবস্থাপনার অন্যতম দুর্বল দিক। স্বাভাবিক কারণেই অনেক বাংলাদেশী গবেষক তাদের গবেষণার ফলাফল সেরা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করছেন এবং স্থানীয় জার্নালে প্রকাশে আগ্রহী নন।
গবেষণা ও জার্নালের মান উন্নয়নের উপায়-
বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আমাদের গবেষণা সংস্কৃতি এবং মনোভাবের প্রকৃত পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে জার্নালগুলো পাণ্ডুলিপির মান, তথ্য বিশ্লেষণ এবং পদ্ধতি ও গবেষণার প্রেক্ষাপটে ফলাফলের ব্যাখ্যার উন্নতিতে মনোনিবেশ করে।
বাংলাদেশের গবেষক ও বিজ্ঞানীদের উচিত এ দেশের কিছু নির্বাচিত জার্নালে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়ে সেগুলোকে স্বল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার চেষ্টা করা। নির্বাচিত জার্নালের দৃশ্যমানতা বাড়াতে বাস্তবসম্মত কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। গুগল সার্চের সময় ওই জার্নালগুলো যেন উপরের দিকে উঠে আসতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতিষ্ঠিত গবেষকদের আর্টিকেল আকৃষ্ট করতে হবে ও সাইটেশন উৎসাহিত করতে হবে। দেশীয় তহবিলপ্রাপ্ত গবেষণার ফলাফল স্থানীয় জার্নালে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
এ জার্নালগুলোর বিশেষ ইস্যু/ভলিউম প্রকাশ করার জন্য বিশ্বমানের বিশেষজ্ঞদের অতিথি সম্পাদক হিসেবে রাখতে হবে যাতে বিদেশী গবেষকদের ভালো মানের আর্টিকেল প্রকাশ করা যায়।
অতিথি সম্পাদকরাও তাদের গবেষণা নেটওয়ার্ক ও সহকর্মীদের উৎসাহিত করবে, যাতে উচ্চমানের আর্টিকেল বিশেষ ইস্যুতে অন্তর্ভুক্ত হয়। অনেক দিন আগে আমি একবার ওপরের টেবিলের ৭ নম্বরের, জার্নাল অব স্ট্যাটিসটিক্যাল রিসার্চের অতিথি সম্পাদক ছিলাম।
সম্পাদকীয় বোর্ডকে দেশী ও বিদেশী গবেষকদের মানসম্মত আর্টিকেল আকৃষ্ট করার জন্য মনোযোগী হতে হবে। জার্নালের মান বাড়ানোর জন্য উত্তম পৃষ্ঠাবিন্যাস, উপযুক্ত ফন্ট ব্যবহার, গ্রাফ/টেবিল নামকরণ, রেফারেন্সিং স্টাইল, সেকশন/সমীকরণ নম্বর, বিষয় শ্রেণীবিভাগ, কি-ওয়ার্ড, লেখকের সংস্থা ইত্যাদি নির্ভুল করতে হবে।
জার্নালের প্রকাশনা নিয়মিত ও সময়মতো করতে হবে ও সফট কপি দ্রুত লেখকদের কাছে পাঠাতে হবে।
নিম্নমানের নতুন জার্নাল প্রকাশ না করে, বিদ্যমান জার্নালের মান উন্নত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের গবেষণায় অগ্রসর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বা দুইটা জার্নালের মান উন্নয়নের চেষ্টা করা।
জার্নালগুলো সবার জন্য উন্মক্ত হলে পাঠকরা বিনামূল্যে পড়তে পারবে, যা সাইটেশন বাড়াতে সহায়ক হবে।
সম্পাদকীয় অফিসকে সাইটেশন এজেন্সির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে, যাতে জার্নাল তাদের ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হয়। পেশাদার সম্পাদকদের সাহায্যে ফরম্যাটিং, বানান ও ব্যাকরণ উন্নত করতে হবে।
গবেষণায় আর্থিক বিনিয়োগ-
বাংলাদেশ বর্তমানে মাত্র জিডিপির দশমিক ৩ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়নে এবং জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করছে। এর তুলনায় অস্ট্রেলিয়া ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ ও যুক্তরাষ্ট্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যয় করে।
গবেষণার মান ও জার্নালের গুণমান উন্নয়নের জন্য সরকার থেকে এ খাতে আরো বেশি অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন, যাতে মেধাবী ভালো শিক্ষক ও গবেষক আকৃষ্ট করা যায়।
আমাদের জাতীয় মান-মর্যাদা বৃদ্ধি ও বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যথাযথ স্থান অর্জন করতে হলে আমাদের জাতীয় নেতৃত্বকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে ও গবেষকদের পেশাগত উন্নয়নের দায়িত্ব নিতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণায় কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন ছাড়া দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্লোবাল র্যাংকিংয়ে স্থান করে নেয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।
- ড. শাহজাহান খান: উপাচার্য, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। সূত্র: বণিক বার্তা

