ছোটবেলায় ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় দেখতাম অধিকাংশই জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলী হওয়ার কথা লিখত। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক-শিক্ষকদের প্রত্যাশা কিংবা বইয়ের নির্দেশনার প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবে যদিও ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিকেল কলেজ কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। বলা চলে, সেখানেই অনেকের স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটে। কিন্তু ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়ার পরও সে পেশায় না গিয়ে বিসিএস জেনারেল ক্যাডারে কেন?
সম্প্রতি ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, এই বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারের শীর্ষ তিনটি স্থানই দখল করেছেন মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বিসিএসের পররাষ্ট্র, পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারে প্রকৌশলী-ডাক্তারদের জয়জয়কার। বিশেষায়িত পেশার জন্য লেখাপড়া করেও অনেকে যেভাবে প্রশাসন, পুলিশ কিংবা পররাষ্ট্র ক্যাডারে চাকরি করছেন, তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ২০২১ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ে এখন বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। এবার ২৩ জনের মধ্যে ১৪ জনই ইঞ্জিনিয়ার, পাঁচজন ডাক্তার।’
একটি বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়া পররাষ্ট্র ক্যাডারের ২৩ জনের মধ্যে ১৯ জনেরই প্রকৌশল ও চিকিৎসাবিদ্যা পড়ে আসার পরিসংখ্যান এক রূঢ় বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ব্যতিক্রম থাকতে পারে নিশ্চয়ই। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান থেকে এটা বোঝা যায়, সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতার কারণেই তারা প্রভাবশালী এসব ক্যাডারে আসছেন। গত আমলে পুলিশের দাপট আমরা দেখেছি। সে সময় পুলিশের রাজনীতিকীকরণ ও ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ করার প্রবণতা থেকেই এ পেশা অনেকের পছন্দের শীর্ষে ছিল। প্রশাসন ক্যাডার এমনিতেই প্রভাবশালী। পদোন্নতি, অন্য ক্যাডারের ওপর ছড়ি ঘোরানো ইত্যাদি দিক থেকে প্রশাসন ক্যাডারের অবস্থান শীর্ষে। এমনকি আমলাতন্ত্রের একচেটিয়া আধিপত্যের কিছুই এ সরকার পরিবর্তন করতে পারেনি। পুলিশ কিংবা আমলাতন্ত্র সংস্কারে কমিশন হয়েছে। কিন্তু আমলাতন্ত্রের বিরোধিতার কমিশনের রিপোর্ট নিয়েই প্রশ্ন আছে। তারও বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে। অভিজাত ক্যাডার হিসেবে পররাষ্ট্রের কথা বলাই বাহুল্য।
প্রকৌশল কিংবা চিকিৎসাবিদ্যায় পড়ুয়ারা মেধার দিক থেকে এগিয়ে থাকেন। সেই মেধার জোরেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো করে বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে কাজ করছেন। অথচ তাদের তৈরির পেছনে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ তো কম নয়। সরকার যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে দুই লক্ষাধিক টাকা খরচ করে, সেখানে বুয়েটের শিক্ষার্থীপ্রতি খরচ হয় তিন লক্ষাধিক টাকা। ঢাকা মেডিকেল কলেজে সে টাকা প্রায় সাড়ে ৪ লাখ। রাষ্ট্রীয় এ বিনিয়োগের বাইরেও জনপ্রত্যাশা থাকে– সংশ্লিষ্টরা তাদের পেশায় নিয়োজিত থেকে মানুষকে সেবা দেবেন।
অথচ গত তিনটি বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ ক্যাডারে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের প্রায় ৩০ শতাংশই মেডিকেল কলেজ বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার তাঁর এক নিবন্ধে বলেছেন, বিশেষায়িত ক্ষেত্র থেকে সাধারণ ক্যাডারে আসার দৃষ্টান্ত এমনকি পাকিস্তান আমলেও নাকি দেখা গেছে। কিন্তু বর্তমানে যে হারে তারা সাধারণ ক্যাডারে আসছেন, সেটা যে উদ্বেগজনক– তাও তিনি বলেছেন।
এটা সত্য, সুযোগমতো যে কোনো কিছু করায় বাধা নেই। এমনকি এসব গ্র্যাজুয়েট অনেকেই দেশের বাইরে চলে যান। তারপরও জনপ্রত্যাশা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে দোষ দেওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য সিস্টেমই দায়ী। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসছে, বিসিএসে বিশেষায়িত ক্যাডার সার্ভিসের সুযোগ-সুবিধা কেমন। প্রকৌশল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি ক্যাডার কতটা বঞ্চিত– সে প্রশ্নও উঠছে।
বিশেষায়িত ক্যাডারগুলোতে পদসংখ্যায় অসামঞ্জস্য, প্রশাসন ক্যাডারের তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা এবং পদোন্নতিতে ধীরগতি নিয়ে পেশাজীবীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রকৌশল কিংবা চিকিৎসায় পড়াশোনা করে এসেও এ ক্যাডারে সরকারিভাবে সঠিক যোগ্যতার বিচার করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার সুযোগও সীমিত। শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা পদ সৃজন ও পদোন্নতি জটিলতায় পড়েন এবং তাদের কর্মজীবনের গতি ধীর। স্বাস্থ্য ক্যাডারেও নানামুখী সমস্যা। এখানে সবারই সাধারণ সমস্যা– পদোন্নতি। প্রশাসন ক্যাডারে শূন্য পদ না থাকা সত্ত্বেও পদের তিন-চার গুণ পদোন্নতির ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে বিশেষায়িত ক্যাডারের সদস্যদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নানা বাধা।

পেশাজীবীদের মর্যাদার বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জেলা-উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভা ইত্যাদির আসন বিন্যাস থেকেও বোঝা যায়। এসব সভায় কলেজের অধ্যক্ষ, কৃষি কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন, মৎস্য কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, নির্বাহী প্রকৌশলী ও অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের জন্য সম্মানজনকভাবে আসন সংরক্ষণ করা হয় না। জেনারেল ক্যাডারের জন্য জনপ্রশাসন পদক, রাষ্ট্রপতি পদক ইত্যাদির মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকলেও বিশেষায়িত ক্যাডারে সেগুলো অনুপস্থিত।
বিশেষায়িত ক্যাডারে একদিকে বঞ্চনা ও বৈষম্য, অন্যদিকে সাধারণ প্রভাবশালী ক্যাডারগুলোতে সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতার কারণেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা এখানে ঝুঁকছেন। এ সমস্যার সমাধান অসম্ভব নয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা যেন তাদের বিশেষায়িত ক্যাডারে প্রত্যাশিত মর্যাদা ও সন্তুষ্টির সঙ্গে কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের পদোন্নতি দিতে হবে; গ্রেড ও বেতন বৈষম্য এমনভাবে বিলোপ করতে হবে, যাতে কেউ সাধারণ ক্যাডারে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে না পারেন। তা ছাড়া অন্যায্য আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অবসানও কম জরুরি নয়।
প্রশাসন ক্যাডার যেহেতু সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকে, তারা সে জন্য নিজেদের সব সুবিধা নিশ্চিত করে অন্যদের বঞ্চিত করবেন, তা হতে পারে না। পুলিশ যেহেতু মাঠ পর্যায়ে ক্ষমতা অনুশীলন করে, তার প্রভাবের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও পায়। পররাষ্ট্র ক্যাডারের অভিজাত হিসেবে সেভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠায় তারা পিছিয়ে নেই। পিছিয়ে আছে কেবল বিশেষায়িত ক্যাডারগুলো। এসব ক্যাডারের প্রতিটি ধরে আলাদা চিন্তা করতে পারে সরকার। শিক্ষকদের জন্য যেমন আলাদা বেতন কাঠামোর দাবি রয়েছে অনেক দিনের।
প্রয়াত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘দেশে কোনো বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধুই প্রশাসক।’ দেশে দক্ষ, মানবিক ও সৎ প্রশাসকের নিশ্চয় প্রয়োজন আছে। কিন্তু সবাই যদি এর পেছনে ছুটতে থাকেন, তবে বিজ্ঞানী, গবেষক ও পেশাজীবী তৈরি হবে কীভাবে? বিসিএস কতটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষা, বলার অপেক্ষা রাখে না। সেখানে যারা বিশেষায়িত ক্ষেত্র থেকে এসে শীর্ষ ক্যাডারগুলোতে অবস্থান করছেন, তাদের সেই মেধা ও যোগ্যতা স্বীয় ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে পেশার উৎকর্ষ সাধিত হতো।
চব্বিশের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের আশা দেখেছিলাম। অন্তর্বর্তী সরকারও কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে সিস্টেম বদলের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। এ সরকারের শেষ সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে, প্রায় সবই মরীচিকা। বিদ্যমান ব্যবস্থার সংকট বহুমুখী। সিস্টেম বদলের মাধ্যমেই কেবল বিসিএসের এই পেশাভিত্তিক সংকটের সমাধান সম্ভব।
- মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ- সহসম্পাদক, সমকাল (সূত্র)

