আগামী ফেব্রুয়ারিতে গণভোট আয়োজনের উদ্দেশে অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি দুটি আইন ঘোষণা করেছে। একটি রাষ্ট্রপতির নামে আদেশ, আরেকটি অধ্যাদেশ। ১৩ নভেম্বর জারি করা হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’। ২৫ নভেম্বর জারি করা হয় ‘গণভোট অধ্যাদেশ, ২০২৫’।
আইনের জুরিসপ্রুডেনশিয়াল জায়গা থেকে প্রথমে কিছু কথা বলা যাক। আমরা জানি যে সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদে আইনের একটা সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশে আইন মানে হলো,‘কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি।’
এখন আইনের এই সংজ্ঞায় ‘আদেশ’ শব্দটির উপস্থিতি থাকলেও রাষ্ট্রপতি যে একটা আদেশ জারি করতে পারেন, সে রকম কোনো বিধান সংবিধানে নেই। ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বড়জোর সংসদের অনুপস্থিতিতে শর্তসাপেক্ষে অধ্যাদেশ নামে আইন জারি করতে পারেন। অথচ ১৩ নভেম্বর জারিকৃত রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে গণভোট আয়োজনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে।
ওই আদেশের প্রস্তাবনার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে সেখানে বলা হয়েছে, ‘…২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার সফল গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শক্রমে, রাষ্ট্রপতি আদেশটি জারি করিলেন।’
এর মানে দাঁড়ায় এই আদেশ জারি করার কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতি পেয়েছেন দুটি উৎস থেকে। এক. গণ-অভ্যুত্থানপ্রসূত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায় এবং দুই. অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শ। কিন্তু এই দুটির কোনোটিরই অস্তিত্ব বর্তমান সংবিধানের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অনেকে যুক্তি দিতে পারেন যে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক এবং জনগণের অভিপ্রায়ই হচ্ছে চূড়ান্ত আর তাই জনগণই সার্বভৌম। ঠিক তা–ই। এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু যুক্তি হিসেবে যা বলা হচ্ছে, তা আংশিক কথন। কেননা ৭ অনুচ্ছেদে জনগণকে সার্বভৌম ঘোষণা করার পাশাপাশি এটাও বলা হয়েছে যে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণের পক্ষে যে ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় (উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, আইন প্রণয়নের মতো বিষয়), তা অবশ্যই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে হতে হবে। তাহলে গণভোটের জন্য রাষ্ট্রপতির নামে জারি করা আদেশ সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
২.
রাষ্ট্রপতির আদেশে এবং গণভোট আয়োজনের নিমিত্তে জারি করা অধ্যাদেশে গণভোটের জন্য একটি প্রশ্ন নির্ধারণ করা হয়েছে। আদেশ ও অধ্যাদেশে গণভোটের জন্য নির্ধারিত প্রশ্নটা মোটামুটি একই রকম রাখা হলেও এই প্রশ্নের অনেকগুলো ভাগ আছে । প্রথমত, সরকার জানতে চাইছে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫-এর প্রতি জনগণের সম্মতি আছে কি না। পাশাপাশি এটাও জানতে চাইছে যে জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত কতিপয় প্রস্তাব (যেগুলো আবার চারটি পয়েন্ট ও অধ্যাদেশের তফসিলে উল্লেখ করা আছে) সম্পর্কে, সেগুলোতেও জনগণ সম্মতি দেবে কি না।
এই দুই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে হবে বলে আইন দুটিতে বলা হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে, প্রশ্নের মধ্যে উত্থাপিত বিষয়গুলো ভিন্ন হলেও জনগণের কাছে প্রশ্নের উত্তর হিসেবে পৃথকভাবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। ‘হ্যাঁ’ বললে পুরো প্রশ্ন সম্পর্কে উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে অথবা ‘না’ বলতে চাইলে সম্পূর্ণভাবে ‘না’ বলতে হবে। প্রশ্নের অন্তর্নিহিত ভাষাগত ও গাঠনিক বৈচিত্র্যতা থাকা সত্ত্বেও কেবল ‘হ্যাঁ’ অথবা কেবল ‘না’ ভোট দিতে হবে।
গণভোটের ক্ষেত্রে প্রশ্ন প্রণয়নের এ ধরনের আঙ্গিক জনগণের ভোটাধিকারকে নিশ্চিতভাবে সংকুচিত করবে। ভোটাধিকার মানে শুধু ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে একটা কাগজ বাক্সবন্দী করা না; বরং দায়িত্বশীলদের কাজ হচ্ছে এটাও নিশ্চিত করা যে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ যে বৈচিত্র্যময় প্রশ্নের উত্তর প্রদানের মাধ্যমে ভোট দিতে চাইবে, সেই উত্তর তথা ভোটদানে যেন জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশে বিকল্প পছন্দ করার ক্ষেত্রে জনগণের কর্তৃত্ব থাকে। কেবল ‘হ্যাঁ’ অথবা কেবল ‘না’ ভোটদানের আইন কীভাবে জনগণের বিকল্প পছন্দ করার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, তা এখন পর্যন্ত আসন্ন গণভোটের জন্য নির্ধারিত প্রশ্নের ভাষা এবং ধরন থেকে নিশ্চিত নয়।
ধরে নেওয়া যাক, কেউ হয়তো প্রশ্নের শুধু প্রথম অংশের জন্য ‘হ্যাঁ’ এবং দ্বিতীয় অংশের জন্য ‘না’ ভোট দিতে চায়। আবার উল্টোটাও হতে পারে। কিংবা দ্বিতীয় অংশের চারটি পয়েন্টে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’-এর বিভিন্ন প্রয়োগ করতে চাইতে পারেন। সোজা কথায়, জনগণ আসলে স্বাধীনভাবে উত্তর দেওয়ার মাধ্যমে গণভোটে অংশগ্রহণ করার কর্তৃত্ব রাখেন—এই বিষয়টা অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত দুটি আইনে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে; বরং গণভোটে উত্থাপিত বিষয়গুলো পুরোপুরি মেনে নিতে বা না নিতে জনগণকে বাধ্য করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে।
৩.
অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, গণভোটের প্রশ্ন নাকি প্যাকেজ আকারে হয়। কথাটা আংশিক ঠিক বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। তবে এ ধরনের উদাহরণও আছে, যেখানে গণভোটের জন্য প্রণীত প্রশ্ন ভাষা ও গঠন—উভয়ের দিক থেকে সুস্পষ্ট, সহজপাঠ্য ও বোধগম্য হওয়ার কারণে প্রশ্নটি আদতে প্যাকেজ প্রশ্ন হলো কি না, তা নিয়ে আলাদা করে ভাবার বা রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় না। সেটা বোঝার জন্য নিকট অতীতে যুক্তরাজ্যে ব্রেক্সিট রেফারেন্ডামের জন্য নির্ধারিত প্রশ্নের দিকে তাকানো যেতে পারে।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত সেই রেফারেন্ডামের প্রশ্নটি ছিল এ রকম: ‘যুক্তরাজ্যের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য থাকা উচিত, নাকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত?’ ভোটের জন্য নির্ধারিত ব্যালটে দুটি বিকল্প দেওয়া হয়েছিল: এক. ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য থাকুক এবং দুই. ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাক। প্রশ্ন হিসেবে খুবই সহজপাঠ্য ও বোধগম্য এবং রেফারেন্ডাম–পরবর্তী ভোটের ফলাফলও ছিল পরিষ্কার।
যাই হোক, ব্রেক্সিট রেফারেন্ডামের প্রশ্নের গঠন ও কাঠামোও কিন্তু সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অংশ থাকা বা না থাকার মতো ‘বাইনারি চয়েজ’সংবলিত প্রশ্ন যুক্তরাজ্যের সমাজ-বাস্তবতায় ব্রেক্সিটকেন্দ্রিক যে বৃহত্তর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিতর্কগুলো ছিল, সেগুলোর কোনো সুরাহা এই রেফারেন্ডাম করতে পারেনি। ফলে ব্রেক্সিট রেফারেন্ডাম বাস্তবায়ন নিয়ে তিনজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর (ডেভিড ক্যামেরন, থেরেসা মে ও বরিস জনসন) শাসনামলে ২০২৩ সাল অবধি রাজনৈতিক জটিলতায় দেখা যায়।
- এর আগে অনুষ্ঠিত তিনটি গণভোটের ফলাফলের দিকে তাকালে বোঝা যায়, আমরা কখনোই গণভোটগুলোকে ন্যায্যতার ধারণার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।
- প্রশ্ন হচ্ছে মূল আইনে অর্থাৎ আদেশে নির্ধারিত প্রশ্নের ভাষা অধ্যাদেশে পরিবর্তন করা যায় কি না? আর এসব শব্দ বাদ দেওয়ার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী?
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে ব্রেক্সিট রেফারেন্ডাম ফলাফল বাস্তবায়ন–সংক্রান্ত চুক্তি পার্লামেন্ট থেকে অনুমোদন করাতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একাধিকবার ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে থেরেসা পদত্যাগ করেন আর একই ঘটনাপ্রবাহে সেপ্টেম্বরে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পার্লামেন্টের সেশন স্থগিত (প্রোরোগেশন) করে দেন। শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং এই স্থগিতাবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বরে হাউস অব কমন্সের পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড কনস্টিটিউশনাল অ্যাফেয়ার্স কমিটি ব্রেক্সিট রেফারেন্ডাম থেকে ব্রিটিশ রাজনীতির জন্য ভবিষ্যতে (ভালো-মন্দ) শিক্ষণীয় কী হতে পারে, সেই বিষয়ে একটা অনুসন্ধানের আয়োজন করে। অনুসন্ধান কমিটির কাছে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যালান রেনউইকের দেওয়া বক্তব্য এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর মতে, অন্তত তিনটি নীতির ওপর ভিত্তি করে রেফারেন্ডামের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। রেফারেন্ডাম হওয়া উচিত সুচিন্তিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায্য।
সুবিবেচনাপ্রসূত বা সুচিন্তিত বলতে অধ্যাপক অ্যালান রেনউইক বুঝিয়েছেন যে রেফারেন্ডামে বর্ণিত বিষয়সমূহের ব্যাপারে জনগণের অবহিত হওয়া ও সতর্কতার সঙ্গে সেখানে উত্থাপিত বিকল্পগুলো নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ থাকতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, রেফারেন্ডামের প্রাক্-আলোচনা থেকে শুরু করে রেফারেন্ডামের ফলাফল বাস্তবায়ন পর্যন্ত সব জায়গায় যেন সবার অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকে। যার যে ধরনের আদর্শ থাকুক না কেন, নীতিনির্ধারক, রাজনৈতিক দল তথা রাষ্ট্রের উচিত হবে সব নাগরিকের উদ্বেগ সহনশীলতার সঙ্গে শোনা ও প্রয়োজনমতো সেগুলোর আঙ্গিকে আইনি কাঠামো তৈরি করা। ন্যায্যতা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, জনগণকে এবং একই সঙ্গে তাদের প্রতিনিধিত্বকারীদের রাজনৈতিক দলকে বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে রেফারেন্ডাম বিষয়ে অন্তত এই মর্মে সম্মত হতে হবে যে রেফারেন্ডামটা একটা গণতান্ত্রিক, পক্ষপাতমুক্ত ও যৌক্তিক প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এই শর্তগুলো আমরা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি, তা ঐকমত্য কমিশনের আলাপ-আলোচনা থেকে শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা ধরনের একপেশে আচরণ-সিদ্ধান্ত এবং সর্বশেষ জুলাই আদেশ জারি হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ার দিকে নজর দিলে অনেকাংশে বোধগম্য হয়।
এটা সত্য যে অধ্যাপক অ্যালান রেনউইক–প্রদত্ত শর্তগুলো সব সময় অনুসরণ করা সম্ভব না–ও হতে পারে। এ জন্য তিনি এটাও মনে করেন, প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে জটিল রাজনৈতিক ও জনজীবন সম্পর্কিত প্রশ্ন মোকাবিলায় রেফারেন্ডামের বিকল্প হতে পারে প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ, যেখানে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে জবাবদিহির আওতায় সমাধানের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে পারেন। কোনো কিছুই রাতারাতি পরিবর্তন বা সংস্কার করা সম্ভব নয়। সেটা স্বৈরশাসকের পতন কিংবা গণতান্ত্রিক উত্তরণ—যেটার কথাই বলি না কেন।

৪.
বাংলাদেশে এর আগে অনুষ্ঠিত তিনটি গণভোটের ফলাফলের দিকে তাকালে বোঝা যায়, আমরা কখনোই গণভোটগুলোকে সুবিবেচনাপ্রসূত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায্যতার ধারণার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে আয়োজিত গণভোট দুটির মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের সামরিক শাসনের বৈধতা অর্জনের জন্য। বৈধতার এই ‘খুঁটির জোরে’ বাংলাদেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা নব্বই সাল পর্যন্ত বারবার হোঁচট খেয়েই গেছে। আবার একানব্বইয়ের গণভোটও অনেকটা আলঙ্কারিকই ছিল। কেননা নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান যে গণতান্ত্রিক পুনর্যাত্রা ও অগ্রগতির স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেটাও পরবর্তী সংসদের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই রাজনৈতিক বিভাজনের পুরোনো ধারায় হারিয়ে গিয়েছিল।
দেশে এখন আসন্ন গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা রকমের টানাপোড়েন চলছে। গণভোটের ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। গণভোটের আগেই গণভোটের প্রশ্ন বিষয়ে জনগণকে সচেতন ও শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে সবাই গুরুত্ব আরোপ করছেন। মনে রাখা দরকার, এটা শুধু সরকার বা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব না। প্রধানত এই দায়িত্ব নিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। কারণ, সরকারের তুলনায় দলগুলো এবং তাদের কর্মী-সমর্থক তৃণমূলে অধিকতর বিস্তৃত ও মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।
অথচ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের জনসম্পৃক্তিমূলক আয়োজনে (পথসভা, উঠান বৈঠক বা কর্মিসভা ইত্যাদিতে) গণভোটের বিষয়ে জনসম্মতি উৎপাদনের পরিবর্তে প্রতিপক্ষের প্রতি বিষোদ্গার, নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়া বা কাদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠানো ঠিক হবে না—এসব বক্তৃতা-বিবৃতিতে বেশি ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। গণভোট বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো যে রকম সিরিয়াস ছিল, এখন তা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
৫.
শেষ করার আগে আরেকবার ফিরে যাওয়া যাক আদেশ এবং অধ্যাদেশে নির্ধারিত প্রশ্নের বিষয়ে। গণভোট বিষয়ে রাষ্ট্রপতির আদেশকে মূল ধরেই যে অধ্যাদেশটা জারি করা হয়েছে, সেখানে কিঞ্চিৎ ‘গরমিল’ দেখা যাচ্ছে। আদেশে প্রশ্নটার (গ) নম্বর পয়েন্টে ‘প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ’ ও ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি’ উল্লেখ থাকলেও অধ্যাদেশে এই একই পয়েন্টে রাখা হয়েছে শুধু ‘প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ’ ও ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা’—এই শব্দসমূহ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মূল আইনে অর্থাৎ আদেশে নির্ধারিত প্রশ্নের ভাষা অধ্যাদেশে পরিবর্তন করা যায় কি না? আর এসব শব্দ বাদ দেওয়ার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী?
পরিশেষে বলতে হয়, বাস্তবতার নিরিখে এটা প্রত্যাশিত নয় যে জটিল ভাষায় ও আঙ্গিকে প্রণীত রাজনৈতিকভাবে উত্থাপিত কঠিন সব প্রশ্নের আদ্যোপান্ত পুরোটা বুঝে জনগণ আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে ভোটকেন্দ্রে যাবেন। গণভোটের প্রশ্ন সহজীকরণসহ অন্যান্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে গণতান্ত্রিক উত্তরণের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কেবলই ‘প্রতীকী’ অর্জনের চেয়ে খুব বেশি হবে কি না, সেই প্রশ্ন হয়তো থেকেই যাচ্ছে।
-
ইমরান আজাদ: আইনের শিক্ষক ও গবেষক। সূত্র: প্রথম আলো

