বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি ঋণের সমস্যায় জর্জরিত। স্বাধীনতার পর থেকে নানা সংস্কার, নীতি পরিবর্তন ও আর্থিক খাত পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এই সমস্যা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ধরন ও বিস্তার পরিবর্তিত হয়ে এখন অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য রীতিমতো হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা ছিল রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং ঝুঁকি মূল্যায়নের অনুপস্থিতি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রায়ই ব্যবসার যোগ্যতা বা প্রকল্পের মূল্যায়ন কম গুরুত্ব পেত।
ঋণ পুনরুদ্ধারের কার্যকর কাঠামো না থাকায় ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে আর্থিক দুর্বলতার দিকে এগোতে থাকে।
তখন ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংযোগ ছিল প্রায় প্রধান যোগ্যতা। সরকারি দলের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা পেতেন বিশেষ সুবিধা।
এটি একসময় অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়। ফলে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক শৃঙ্খলা ধ্বংসের পথে যায়।
স্বাধীনতার ২০ বছর পর ১৯৯১ সালে প্রথম পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করে তৎকালীন সরকার।
তাতেই এক হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে যায়। দেশের মানুষ প্রথমবারের মতো জানতে পারে, কারা কারা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করে না।
এরপর থেকে দফায় দফায় সেই খেলাপি ঋণের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। এটি আর থামেনি।
বিশেষ করে ১৯৯৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। তখন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে উচ্চ ঝুঁকির হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
২০০০ সালের আগে-পরে কিছু বেসরকারি ব্যাংক বাজারে প্রবেশ করলে প্রতিযোগিতা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হয়।
ক্রেডিট মূল্যায়ন, করপোরেট গভর্ন্যান্স এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে খেলাপি ঋণের হার ক্রমে কমতে থাকে।
২০০৫ সালে খেলাপি ঋণের হার নেমে আসে প্রায় ১৩ শতাংশে। এটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচক ছিল।
এরপর ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। যদিও ২০১১ সালে খেলাপি ঋণের হার ৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসে, তবে বড় বড় অর্থ কেলেঙ্কারির পরে তা আবার বাড়তে থাকে।
২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারির পর ব্যাংকিং খাত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। বিভিন্ন সার্কুলার ও নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে কার্যকারিতা অনেক ক্ষেত্রে সীমিত।
ঋণ আদায়ের আইনি কাঠামো দুর্বল থাকায় ঋণখেলাপিদের যথাযথ শাস্তি কার্যকর হয়নি। কোভিড কাটিয়ে কিছুটা স্থিতিশীলতা এলে ২০২৩ সালের শেষে গিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
এর মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে ৬৫ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা বেড়ে ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ গিয়ে ঠেকে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায়।
বছরের শেষে প্রকৃত মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ কোটি, যা মোট ঋণের ২০ শতাংশের বেশি।
২০২৫ সালের জুনে ঋণ বেড়ে হয় ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা এবং সেপ্টেম্বর নাগাদ ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসে বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি।
বাংলাদেশের বর্তমান খেলাপি ঋণের হার ৩৬ শতাংশ এশিয়ার গড় ১.৬ শতাংশের তুলনায় বিপজ্জনকভাবে বেশি।
এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার গড় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং নেপালের ৪ দশমিক ৪ শতাংশ থেকেও অনেক বেশি।
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অস্থিতিশীলতার কারণে ২০২৫ সালে সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। কারণ, একই সময়ে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি, যা ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি কমিয়ে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতি আমানতকারীর অর্থ, ব্যাংকের মূলধন এবং সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ব্যাংক খাতের ক্ষত কমাতে আরও ৫-১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সমন্বয়ে নতুন একীভূত ব্যাংক ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ গঠন করা হয়েছে।
রিশিডিউল ও ফরবিয়ারেন্স ব্যবস্থার মাধ্যমে বড় ঋণগ্রহীতাদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।
এর মধ্যে আছে—দীর্ঘ মেয়াদি পুনর্গঠন, নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট, সুদ মওকুফ এবং ডিফল্ট মার্কিং স্থগিতকরণ। এসবের ফলে কাগজে ঋণ কম দেখালেও বাস্তবে প্রকৃত অর্থ ফেরত আসেনি।
জানা গেছে, মোট খেলাপি ঋণের ৫০ শতাংশের বেশি মাত্র ২০০টি বড় ঋণগ্রহীতার কাছে।
ছোট ব্যবসায়ীরা নিয়মিত শোধ করলেও করপোরেট গ্রুপগুলো সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে, যা ‘ক্রেডিট কনসেন্ট্রেশন রিস্ক’ হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বহু বছরের পুরোনো ঋণ এখনো উদ্ধার হয়নি।
২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকার কোটির ঋণের বিপরীতে অর্থঋণ আদালতগুলোয় প্রায় পৌনে এক লাখ খেলাপি ঋণের মামলা ঝুলে আছে।
ধারণা করা হচ্ছে দীর্ঘসূত্রতাপূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ার কারণে ঋণ পুনরুদ্ধার ট্রাইব্যুনাল ও হাইকোর্টে এখনো প্রায় ১ লাখ মামলা ঝুলে আছে। যার মধ্যে অনেক মামলা নিষ্পত্তিতে ৭-৮ বছর সময় লাগে।
রাজনৈতিক ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবও ব্যাংক খাতে মোরাল হ্যাজার্ড বাড়িয়েছে।
গত এক দশকে খেলাপি ঋণ তিন গুণের বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালে তৈরি পোশাক খাতটিতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা যা এ খাতের বিতরণকৃত ঋণের ২৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ, বস্ত্র খাতে বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ, চামড়াশিল্পে বিতরণকৃত ঋণের ৩৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ, জাহাজনির্মাণ ও ভাঙাশিল্পে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৩৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্প খাতে বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ, ওষুধ খাতে বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ, উৎপাদনমুখী অন্যান্য বৃহৎ শিল্পে বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং কৃষিভিত্তিক উৎপাদনমুখী শিল্পে বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
ব্যাংকভেদেও খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি ভিন্ন, যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকের ৩৯ শতাংশ, প্রাইভেট ব্যাংকের ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংকের ৬ দশমিক ১ শতাংশ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ স্বচ্ছতা যেখানে বেশি, খেলাপি সেখানে তুলনামূলক কম।
অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণের প্রভাবে যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে, ব্যাংক অনিশ্চয়তায় থাকায় আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে চাপ পড়ছে।
অর্থনীতির এই গতি ফেরাতে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
এর অংশ হিসেবে উইলফুল ডিফল্টার আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে, ব্যাংক পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও পেশাদারি নিশ্চিত করতে হবে, ঋণখেলাপিদের দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে, রিশিডিউল ও ফরবিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে এবং বড় করপোরেট গ্রুপের নির্দিষ্ট ঋণসীমা ঠিক করতে হবে।
মনে রাখা দরকার, খেলাপি বা মন্দ ঋণ শুধু অর্থনৈতিক সমস্যাই নয়—এটি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতারও ফল।
আরও মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের দরজায় দাঁড়িয়ে কিন্তু ব্যাংকিং খাতের ঘনীভূত ঝুঁকি আগামী দিনের প্রবৃদ্ধির গতি কমিয়ে দিতে পারে।
-
এম এম মাহবুব হাসান: ব্যাংকার, উন্নয়ন গবেষক ও লেখক। সূত্র: প্রথম আলো

