পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। এর মধ্যে কৃষি সবচেয়ে আদিম ও অকৃত্রিম একটি পেশা। এটি খুবই পরিশ্রমসাপেক্ষ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কৃষকদের উদয়াস্ত খাটুনি ছাড়া কৃষির উৎপাদন সম্ভব হয় না।
পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। এর মধ্যে কৃষি সবচেয়ে আদিম ও অকৃত্রিম একটি পেশা। এটি খুবই পরিশ্রমসাপেক্ষ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কৃষকদের উদয়াস্ত খাটুনি ছাড়া কৃষির উৎপাদন সম্ভব হয় না। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও আহার জোগানোর জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করতে হয় কৃষকদের। তদুপরি অনেক ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা রয়েছে কৃষির উৎপাদনে। বন্যা কিংবা খরায় ফসল নষ্ট হলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হন কৃষক।
তাছাড়া ক্রমাগতভাবে উপকরণ মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষিকাজে মুনাফা হ্রাস পাচ্ছে। অনেক সময় উৎপাদন খরচটুকুও উঠে আসছে না কৃষকদের। ফলে কৃষি ছেড়ে ভিন্ন পেশায় পাড়ি জমাচ্ছে গ্রামের মানুষ। ফসলের ভরা মৌসুমে দেখা যাচ্ছে শ্রমিক সংকট। দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে কৃষি শ্রমিকের মজুরি। অন্যদিকে কৃষি থেকে সম্পদ ও পুঁজি চলে যাচ্ছে আধুনিক খাতগুলোয়। তাতে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে কৃষির বিনিয়োগে। ফলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় কৃষিতে সহায়তা প্রদান ও মূল্য সমর্থন দেয়া একান্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি খাতে সহায়তা দেয়া যায় সরকারি বাজেটের মাধ্যমে। তাছাড়া সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য সংকোচনের মাধ্যমেও সহায়তা দেয়া হয় অভ্যন্তরীণ কৃষির উৎপাদনকে। কৃষিকে সহায়তা প্রদানের সময় একটি বড় কৌশল হচ্ছে পণ্যের মূল্য সমর্থন। এক্ষেত্রে প্রণয়ন করা হয় কৃষি মূল্যনীতি। কৃষিপ্রধান উন্নয়নশীল দেশগুলোয় উল্লিখিত সব সহায়তা ও সমর্থনই কম-বেশি বিদ্যমান। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে সহায়তা ও সমর্থনের মাত্রা নিয়ে। বাজেটের সহায়তার ক্ষেত্রে আমাদের কৃষিতে ব্যয়ের পরিমাণ দিনের পর দিন নিরঙ্কুশ টাকার অংকে ক্রমেই বাড়ছে; কিন্তু হ্রাস পাচ্ছে আপেক্ষিক অর্থে। কৃষিতে প্রণোদনা জোগানের জন্য প্রদত্ত ভর্তুকির পরিমাণও আপেক্ষিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ১২ বছর আগে মোট বাজেটের ৬ শতাংশেরও বেশি ব্যয় করা হয়েছিল কৃষি ভর্তুকি খাতে। এখন তা নেমে এসেছে ২ শতাংশেরও নিচে।
একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে কৃষি খাতে সহায়তা ও সমর্থন প্রদানের কোন সীমারেখা বাংলাদেশের জন্য নির্ধারণ করা নেই। অর্থাৎ কৃষিতে স্বদেশী সহায়তা হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে পুরোপুরি ছাড় দেয়া হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালায়। ২০২৬ সালের পর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান নিশ্চিত হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী মোট কৃষি উৎপাদনের ১০ শতাংশ পর্যন্ত কৃষি ভর্তুকি খাতে ব্যয় করা যাবে। তাতে বর্তমান বাজারদরে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা যাবে কৃষি ভর্তুকি খাতে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের মাত্র প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থ ব্যয় করছে কৃষি ভর্তুকির জন্য।
কৃষিতে সহায়তা প্রদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে পণ্যের মূল্য সমর্থন। এর জন্য দরকার একটি মূল্যনীতি। এর মাধ্যমে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান। অন্যদিকে ন্যায়সংগত মূল্যে পণ্য ক্রয়ের নিশ্চয়তা পান ভোক্তা। বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ গ্রামীণ জীবন কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে গরিব মানুষের প্রায় ৬৫ শতাংশ পারিবারিক ব্যয় নিয়োজিত হয় খাদ্য কেনার জন্য। এ অবস্থায় কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের জন্যই একটি ইতিবাচক কৃষি মূল্যনীতি প্রয়োজন। এর মাধ্যমে কৃষকের আয় স্থিতিশীল রাখা যায়, কৃষিপণ্যের মূল্য ওঠানামার মাত্রা সংযত করা যায় এবং পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে রফতানি বৃদ্ধি ও আমদানি হ্রাস করা যায়। ভারতসহ পৃথিবীর উন্নয়নশীল ও ইউরোপীয় দেশগুলো অত্যন্ত কৃষকবান্ধব মূল্যনীতি বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশে এর প্রয়োগ ও বিস্তার তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
কৃষি মূল্যনীতির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে পণ্যের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করা। এটা প্রতি বছরই নির্ধারণ করা হয় সরকারিভাবে। কৃষকের জন্য উৎপাদিত পণ্যের ন্যূনতম মুনাফা নিশ্চিত করা এর উদ্দেশ্য। ভারতে বর্তমানে ২৩টি কৃষিপণ্যের সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত মূল্যের নিচে যাতে বাজারদর নেমে না যায় সেজন্য সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে নেয় সরকার। ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে ভারত সরকার নিভিন্ন কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছে উৎপাদন খরচের ওপর ৫০ শতাংশ মুনাফা হিসাব করে। মোট উৎপাদিত পণ্যের ১৫ শতাংশ ক্রয় করা হচ্ছে এরূপ পূর্বনির্ধারিত মূল্যে। বাংলাদেশে ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই।
তবে প্রচলন আছে ধান-চাল ও গমের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের। এটা সাধারণত উৎপাদন খরচের ওপর ৬-১০ শতাংশ মুনাফা দেখিয়ে নির্ধারণ করা হয়। এর পরিধিও সীমিত। মোট উৎপাদনের মাত্র ৫-৬ শতাংশ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয় উৎপাদন মৌসুমে। তারও অধিকাংশ ক্রয় করা হয় ব্যবসায়ী ও চাতাল মালিকদের কাছ থেকে। কৃষক তাতে সরাসরি লাভবান হন না। ফলে আমাদের দেশে প্রচলিত উৎপাদিত পণ্যের সংগ্রহ মূল্য স্থানীয় বাজারে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তাতে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন কৃষক। অনেক সময় উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে কৃষক তার উৎপাদন খরচটুকুও ঘরে নিয়ে আসতে পারে না।
কৃষিপণ্যের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের জন্য কিছু নিয়ম প্রচলিত আছে। সেক্ষেত্রে আগের বছরের পণ্যমূল্য, উৎপাদন খরচ, খোলা বাজারে পণ্যমূল্যের চালচিত্র, আন্তর্জাতিক বাজারদর, সরকারি মজুদ ও মূল্যস্ফীতির হার ইত্যাদি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আমাদের দেশে বর্তমানে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় মূলত উৎপাদন খরচের ওপর ভিত্তি করে। তাও সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে নয়। উদাহরণস্বরূপ ২০১৮ সালের আমন মৌসুমে উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি কেজি চাল ৩৪ টাকা। অনেকের মতে তা ৩৮ টাকা। ২০১৭ সালে সরকারিভাবে তা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৭ টাকা।
প্রতি বছর যেহেতু উপকরণ খরচ বাড়ছে সেহেতু উৎপাদন খরচ হ্রাসের কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না। এটা স্পষ্টই অসংগতি। ২০১৮ সালে আমন চালের সংগ্রহ মূল্যও আগের বছরের তুলনায় ৩ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৬ টাকা। আগের মৌসুমের বোরো চাল সংগ্রহ মূল্যের চেয়েও তা ছিল ২ টাকা কম। এ নিয়ে উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে উৎপাদন খরচ নির্ধারণের জন্য তিনটি সংস্থা নিয়োজিত রয়েছে। এদের পক্ষ থেকে যে হিসাব উপস্থাপন করা হয় তাতে ফারাক থাকে অনেক। স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দেশে রয়েছে ‘এগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন’। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে এখন কৃষি মূল্য কমিশন কার্যকর রয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের উদাহরণ আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। সেখানে কৃষি মূল্য কমিশন স্থাপিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। এখনো তা অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এতে একজন চেয়ারম্যান এবং দুইজন সদস্যসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য লোকবল রয়েছে।
এ কমিশনের কাজ হলো পণ্যের উৎপাদন খরচ নির্ণয় করা, ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করা এবং কৃষিপণ্যের রফতানি মূল্য নির্ধারণ ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করা। মাঠের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং কৃষি উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন তাদের সুপারিশ পেশ করে থাকে। তাদের সুপারিশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাই মেনে নেয়। বাংলাদেশে এরূপ একটি প্রাইস কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। আমাদের জাতীয় কৃষিনীতিতেও একটি প্রাইস কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি।
কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন সহায়তা ও সমর্থন প্রদানের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর মধ্যে উপকরণ ভর্তুকি ও পণ্যের মূল্য সমর্থন অন্যতম। বাংলাদেশে উপকরণ ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি বহুল আলোচিত হলেও পণ্যের মূল্য সমর্থনের বিষয়ে তেমন গুরুত্বসহ আলোচনা হয় না। ফলে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে প্রতিনিয়তই কৃষক বঞ্চিত হলেও এর সমাধানের জন্য তেমন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। এ বিষয়ে বর্তমান সরকার আশু দৃষ্টি দিতে পারে। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার হলো একটি ইতিবাচক কৃষি মূল্যনীতি প্রণয়ন করা।
এ লক্ষ্যে গঠন করা দরকার একটি কৃষি মূল্য কমিশন। এর প্রধান কাজ হবে উৎপাদন খরচ নিরূপণ ও পণ্য মূল্য নির্ধারণ করা এবং আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপগুলোর জন্য সুপারিশ করা। কৃষি উৎপাদনের ভরা মৌসুমে কোন বছর কী পরিমাণ কৃষিপণ্য সংগ্রহ করা হবে এবং বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য কখন কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে তারও পরামর্শ দেবে কৃষি মূল্য কমিশন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে এটি আত্মপ্রকাশ করতে পারে। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
ড. জাহাঙ্গীর আলম: একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ; সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ (ইউজিভি) ও সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)। সূত্র: বণিক বার্তা

