২০১৮ সালে মারা গিয়েছিলেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভার বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন দিপু। মারা যাওয়ার পাঁচ বছর পর ২০২৩ সালে তাঁকেসহ বিএনপির নেতা-কর্মীদের আসামি করে সেই উপজেলার তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন একটি মামলা করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও বিদেশে থাকা প্রবাসীকেও এই মামলায় জড়ানো হয়েছিল।
শুধু এমন একটি ঘটনা নয়, গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক ‘গায়েবি মামলায়’ বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নেতা-কর্মীরা জেলে থেকেছেন, অপরাধ না করেও শাস্তি ভোগ করেছেন। এমনকি কোনো ঘটনা ঘটেইনি এমন ক্ষেত্রেও সাজানো মামলায় অসংখ্য মানুষকে আসামি করে ঘরবাড়ি ছাড়া করা হয়েছিল। ভিত্তিহীন মামলায় জেল-নির্যাতন ও হয়রানি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
৬ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও অন্যদের বিরুদ্ধে করা হয়রানিমূলক (যা অনেক ক্ষেত্রে গায়েবি মামলা হিসেবে পরিচিত) মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাঁর মধ্যে ২০ হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে আরও যাঁরা এসব হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁদের আগামী ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে দরখাস্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বিনা অপরাধে কেবল রাজনৈতিক আক্রোশের জায়গা থেকে কেউ দিনের পর দিন জেলে থাকবে তা কেবল অমানবিকই নয়, নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার দেওয়ার যে অঙ্গীকার তার প্রায়োগিক দায়বদ্ধতা স্পষ্ট করে। ফলে এ ধরনের ‘গণবিজ্ঞপ্তি’ অবশ্যই বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা তৈরির পথ তৈরি করে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে সরকার এসব গায়েবি মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেই সরকারের আমল কি গায়েবি মামলার কলঙ্ক থেকে মুক্ত আছে? যে সরকার ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত গায়েবি মামলার কথা জানাচ্ছে, সেই সরকার ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে কি কোনো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হয়নি? বলতেই হয়, এ গণবিজ্ঞপ্তিতে সরকারের ১৫ মাসের আমলনামা প্রতিফলিত হয়নি।
এই সরকারের আইন উপদেষ্টা হওয়ার আগে আসিফ নজরুল নিজেই এক কলামে লিখেছিলেন, ঘটনাগুলো এমন সাজানো বা বানানো হয়ে থাকে বলে এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে গায়েবি মামলা। ঘটনা যে সাজানো, তার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় এসব মামলায় মৃত, কারাবন্দী বা বিদেশে থাকা ব্যক্তিদের আসামি করার বহু নজির থেকে। গায়েবি মামলার ওপর বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে, এমনকি এ-ও দেখা গেছে যে মামলায় আহত হিসেবে বর্ণিত ব্যক্তি বলেছেন, তিনি আসলে আহত হননি বা বাদী বলেছেন, তিনি আসলে কারও নির্দেশে মামলা করেছেন, জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করা মানুষ বলেছেন, ধরিয়ে দেওয়া কাগজ না দেখেই তিনি তাতে স্বাক্ষর করেছেন।
পাঠক চলুন এবার কিছু ঘটনার আলোকপাত করা যাক। গত বছরের ৩ জুন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি বাবুল মিয়া মারা যান কিন্তু ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন এই নেতা এবং তাঁকে হত্যা করা হয় উল্লেখ করে ২২ আগস্ট একটি মামলা করেন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন।
গত বছরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট মো. আল আমিন মিয়া (৩৪) মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচার গুলি চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয় দাবি করে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনের নামে মামলা করেন নিহত ব্যক্তির স্ত্রী কুলসুম বেগম (২১)। কিন্তু পরে দেখা যায়, সেই নিহত স্বামী তিন মাস পর ফিরে এসেছেন।
শুধু গায়েবি মামলাই নয়, মিথ্যা মামলায়ও জড়ানো হয়েছে অনেক মানুষকে। যেমন, এই সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টার বিরুদ্ধেই রামপুরায় একটি হত্যাকাণ্ডের মামলা করা হয়। যেখানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনকে আসামি করা হয়, সেখানে ৪৯ নম্বর আসামি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর তাঁকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় । কিন্তু অন্য ৫৬ জনকে মামলার আসামিই রাখা হয়। তাঁরা সবাই কি ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? একই ভাবে জুলাই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া। যদিও তিনি সেই সময় দেশেই ছিলেন না, কিন্তু মিথ্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তারের পর নানামুখী সমালোচনার পর থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জুলাই আন্দোলনে আহাদুল ইসলামকে হত্যার অভিযোগে গত বছরের অক্টোবরে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জহিরুল ইসলাম খান পান্নাসহ (জেড আই খান পান্না) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ ১৮০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছিলেন নিহতের বাবা মো. বাকের। অথচ জুলাইয়ে ছাত্র–জনতার উপর গুলি চালানো বন্ধ করতে রিটকারী আইনজীবী ছিলেন জেড আই খান পান্না। ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে মামলা থেকে তাঁর নামটি প্রত্যাহার করা হয়।
এই কয়েকটি কেবলই উদাহরণ দিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমরা যদি গত ১৫ মাসে এই সরকারের আমলে হওয়া মামলাগুলো বিশ্লেষণ করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে, এসব মামলার অনেকগুলোতে প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক আধিপত্য, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কিংবা দখলের নিমিত্তে হাজার হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পাশাপাশি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পত্রিকার সাংবাদিক-সম্পাদক, লেখক, খেলোয়াড় বা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দেওয়া হয়েছে, কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কেউ জামিন পেয়েছেন, কেউ এখনো কারাগারে আছেন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলেও একই স্টাইলে একই এজাহারের ভাষায় দেশজুড়ে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক’ মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। ওঁদের না হয়েছে জামিন, না হয়েছে মামলার তদন্ত। এসব গায়েবি মামলা নিয়ে আমাদের সুশীল সমাজের কোনো মাথাব্যথা নেই। সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোও এসব সাংবাদিকের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার নয়। ফলে সাংবাদিকতায় মানবাধিকার সুরক্ষায় যে প্রতিশ্রুতি থাকে, তা কার্যত দেখা মিলছে না।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের ভাষায় বলতে হচ্ছে, এসব গায়েবি মামলায় যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের অনেকেই জামিনের ব্যবস্থা করতেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মামলাগুলো তো বাতিল হচ্ছে না। সেগুলোর হাজিরা চলবে ভবিষ্যতে। কত দিন? আলী রীয়াজ এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
দুঃখজনক হচ্ছে, এক সময় গায়েবি মামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা মানুষগুলোও এখন আর গায়েবি মামলার তালাশ করতে পারছেন না। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় ভারী হওয়া কাঁধকেও মুক্ত করতে পারছে না সরকার। বরং পুরোনো চক্রেই নিজেরা আটকে পড়েছে। যা আমাদের জন্য বড়ই হতাশার, লজ্জার।
গায়েবি মামলা যদি প্রত্যাহারই করতে হয়, তাহলে সরকারের উচিত হবে তাদের নিজেদের আমলেও ভুতুড়ে মামলায় শত শত আসামিদের এই ভয়াবহ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের সরলরৈখিক মানসিকতার প্রমাণ দেওয়াও সম্ভব হবে। নয়তো গায়েবি মামলার এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। এর দায় থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেদের মুক্ত করার কোনো সুযোগ পাবে না।
ড. নাদিম মাহমুদ লেখক ও গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: nadim.ru@gmail.com
সূত্র: প্রথম আলো

