বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ দীর্ঘদিন ধরেই অপ্রতুল, পাশাপাশি এ বরাদ্দের কার্যকর বাস্তবায়ন ব্যবস্থাও দুর্বল। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে নাগরিকদের ওপর—চিকিৎসা ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কোটি মানুষের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস (১৯৯৭-২০২০) অনুযায়ী, দেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশই আসে ব্যক্তির সরাসরি পকেট থেকে (আউট-অব-পকেট বা ওওপি ব্যয়), যা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চগুলোর একটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ওওপি ব্যয় ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি হলে তা জনগণের জন্য মারাত্মক আর্থিক ঝুঁকি সৃষ্টি করে; বাংলাদেশে এ হার তার দ্বিগুণেরও বেশি।
অন্যদিকে সরকার মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের মাত্র ২২-২৩ শতাংশ বহন করে। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দীর্ঘদিন ধরেই প্রায় ৫ শতাংশের আশপাশে সীমাবদ্ধ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও তা মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। জিডিপির শতাংশ হিসাবে এ বরাদ্দ আরো কম—মাত্র দশমিক ৭৪ শতাংশ, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ কমপক্ষে ৫ শতাংশ। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয় জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তুলনায় অনেক কম।
বরাদ্দ কম হওয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়ন দক্ষতাও অত্যন্ত দুর্বল। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা, দুর্বল পরিকল্পনা এবং বরাদ্দের একটি বড় অংশ অব্যয়িত থেকে যাওয়ার প্রবণতা সরকারকে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে নিরুৎসাহিত করছে। এ পরিস্থিতিতে উচ্চ ব্যয়ের চাপ দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারকে আরো দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে; অনেকেই ব্যয়ের ভয়ে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে না।
তবে উচ্চ ওওপি ব্যয়ের মূল কারণ হলো সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কার্যকারিতার ঘাটতি। অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, জনবল সংকট, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়, যন্ত্রপাতির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং প্রকিউরমেন্ট থেকে শুরু করে ডিসপেনসিং পর্যন্ত পুরো সরবরাহ ব্যবস্থাই ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ না থাকার মতো সমস্যার কারণে সরকারি হাসপাতালগুলো কাঙ্ক্ষিত মানের সেবা দিতে ব্যর্থ হয়।
ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারি চিকিৎসার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ পরিস্থিতির পেছনে দেশের পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা (যেমন স্বাস্থ্যসেবাকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের আওতাভুক্ত করা) ছাড়াও শীর্ষ নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলোর—যেমন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন—উদাসীনতা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনা ও নীতিগত দুর্বলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
দেশের স্বাস্থ্য খাতকে বর্তমান অচলাবস্থা থেকে বের করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নিয়ে যেতে হলে সরকারকে দ্রুত, সুসংগঠিত এবং সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য সারা দেশের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একটি কাঠামোগত রূপান্তরের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, জটিলতা এবং অদক্ষতায় আক্রান্ত এ ব্যবস্থাকে সঠিক পথে ফেরাতে হলে প্রথমে তিনটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে: (১) জনগণ কি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ক্ষমতায়িত? (২) সরকারি সেবা প্রদানকারীরা কি সেবা দিতে যথেষ্ট উৎসাহিত ও প্রণোদিত? (৩) স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের প্রতি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আকর্ষণ আছে কি?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমান বাস্তবতায় এ তিন প্রশ্নের কোনোটির উত্তর সন্তোষজনক নয়। ফলে এমন একটি নীতি কাঠামোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে যা এ তিন ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তন নিশ্চিত করতে পারে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে জনগণকে কীভাবে ক্ষমতায়িত করা যায় তা প্রথমে আলোচনা করা যাক। ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকে যথাযথ প্রাধান্য না দেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসচেতনতা ও প্রায়োগিক স্বাস্থ্যশিক্ষার অভাব এবং দেশে আইনের শাসন কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত না থাকায় জনগণ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে পর্যাপ্তভাবে ক্ষমতায়িত নয়। ফলে অনেক মানুষই জানে না—কখন, কোথায় এবং কী ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নিতে হবে অথবা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভোক্তা হিসেবে তাদের অধিকার কী। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণেও দেখা যায় আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। এসব কারণ সামগ্রিকভাবে জনগণের স্বাস্থ্যসচেতনতা, প্রতিরোধমূলক আচরণ এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতাকে দুর্বল করে দেয়।
এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে জনগণের হাতে এমন একটি অধিকারভিত্তিক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যা জনগণকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে কার্যকরভাবে ক্ষমতায়িত করবে। স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তনের মাধ্যমে একটি অধিকারভিত্তিক ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব, যা নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার আইনগত প্রাপ্যতাকে নিশ্চিত করে।
তাই স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য প্রতিটি পরিবারকে বার্ষিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবহারের একটি নির্দিষ্ট সীমা বা সিলিংভিত্তিক পারিবারিক স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান করা যেতে পারে, যেখানে উল্লেখ থাকবে—পরিবারটি বছরে কত টাকার স্বাস্থ্যসেবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাবে। এ ব্যবস্থা জনসাধারণকে সরকারি হাসপাতালে ফিরে আসতে উৎসাহিত করবে এবং তাদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট উপলব্ধি তৈরি করবে যে তারা কী ধরনের সেবা পাওয়ার অধিকারী। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো নির্দিষ্ট সেবার ঘাটতি থাকলে কৌশলগত-ক্রয় চুক্তির মাধ্যমে নির্বাচিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেই সেবা প্রদান করা যেতে পারে, তবে অগ্রাধিকার থাকবে সরকারি ব্যবস্থার দ্বারাই অধিকাংশ সেবা প্রদানের ওপর।
এর সমান্তরালে সার্বিকভাবে সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ইকো-সিস্টেমকে সেবাদানে আরো সক্ষম ও প্রস্তুত করতে হবে। একই সঙ্গে সেবা প্রদানকারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা নিশ্চিতের পাশাপাশি পারফরম্যান্সভিত্তিক প্রণোদনা চালু করতে হবে। পদোন্নতি, বদলি ও পোস্টিং-সংক্রান্ত জটিলতাও কমাতে হবে, যাতে তারা জনস্বার্থে সেবা দিতে যথেষ্ট প্রেরণা অনুভব করেন।
এক্ষেত্রে তুরস্কের উদাহরণ অনুকরণযোগ্য। স্বাস্থ্য রূপান্তর কর্মসূচির অধীনে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জন্য তুরস্ক কর্মক্ষমতাভিত্তিক পারিশ্রমিক ব্যবস্থা চালু করে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মীদের কর্মদক্ষতা ও প্রচেষ্টার ভিত্তিতে কর্মক্ষমতা বোনাস প্রদান করা হয় যা তাদের আয় বৃদ্ধি করে। এছাড়া সরকার স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগে সমতা আনতে কম আর্থসামাজিক উন্নয়নের অঞ্চলে কর্মরত কর্মীদের জন্য তাদের বেতনের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত অবস্থানভিত্তিক প্রণোদনা প্রদান করে। এ সমন্বিত প্রণোদনা প্যাকেজ স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে, কর্মীদের উৎসাহিত করতে এবং বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মী ধরে রাখতে সাহায্য করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের প্রতি রাজনৈতিক আগ্রহ কীভাবে তৈরি করা যায়। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের প্রতি রাজনৈতিক আকর্ষণ তৈরির জন্য প্রতিটি সেবার মূল্য বা ভ্যালু নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য ডায়াগনস্টিক গ্রুপ অনুযায়ী প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবার ভ্যালু ইনপুট করতে হবে। এতে তিনটি সুবিধা হবে: রোগী জানতে পারবে সে কোন সেবার বিনিময়ে কত মূল্যের সুবিধা পাচ্ছে, ফলে সরকারি হাসপাতালের সেবাদানকারীদের প্রতি তার আস্থা, শ্রদ্ধা ও ভক্তি বৃদ্ধি পাবে; সেবা প্রদানকারী ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানতে পারবে তারা কত মূল্যের সেবা দিচ্ছে, যার মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা ও দুর্বলতা শনাক্ত করে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে পারবে এবং হাসপাতালের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা তৈরি হবে যা মানোন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
এ পুরো রূপান্তরের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে সিলিংভিত্তিক পারিবারিক স্বাস্থ্য কার্ড। এ কার্ড ব্যবহার করে সেবা নিলে সরকারের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে—রোগীর জন্য কত মূল্যের সেবা তৈরি হলো। যদি দেখা যায়, সরকারের ব্যয়ের তুলনায় সৃষ্ট সেবার মূল্য ৩-১০ গুণ বেশি, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের রাজনৈতিক গুরুত্ব আরো স্পষ্ট হবে। আর যদি দেখা যায় ব্যয়ের তুলনায় সেবার মূল্য কম, তাহলে দ্রুত সমস্যার উৎস শনাক্ত করে সমাধান করা সম্ভব হবে।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে নিতে আমাদের প্রয়োজন মূলত তিনটি বিষয়ের সমন্বয়—ক্ষমতায়িত জনগণ, উৎসাহিত সেবা প্রদানকারী এবং রাজনৈতিকভাবে মূল্যায়িত বিনিয়োগ। এ তিন শর্ত পূরণ করা গেলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শুধু পুনরুজ্জীবিতই হবে না, বরং বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথেও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে পারবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: বণিক বার্তা

