ড. মোস্তফা কে মুজেরী, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ। এছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ও সিরডাপের গবেষণা পরিচালকও ছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া, অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন, দারিদ্র্য, বৈষম্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসের যে ধারাবাহিকতা অতীতে দেখা গেছে, তা বর্তমানে বিঘ্নিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুখে এর পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে বলে মনে করছেন?
সাধারণভাবে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়েছে, যদিও বিভিন্ন দশকে এর তারতম্য দেখা গেছে। তবে দারিদ্র্যের অনুমান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারণ বিশেষ করে গত দশকে তথ্য কারসাজির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের কর্মক্ষমতা উন্নত দেখানোর জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সালের বিবিএস অনুমান অনুসারে, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্য কমার প্রবণতায় ব্যত্যয় দেখা গেছে। ২০২২ সালের পরবর্তী সময়ে বিবিএসের কোনো তথ্য নেই।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন আপডেট অনুসারে, ২০২৪ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৫ সালে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক ২ শতাংশে। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। দারিদ্র্য বাড়ার অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। তিন বছরের অধিক সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। কোনো পদক্ষেপেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমছে না। খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। এটি দারিদ্র্যকে আরো বেশি আঘাত করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপটি দরিদ্র শ্রেণী বা স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এতে যারা দরিদ্র তারা আরো বেশি দরিদ্র হয় এবং যারা দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে আছে তারাও দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসে। এছাড়া অর্থনীতিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে; বিনিয়োগ নেই; কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।
বেকারের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। সবচেয়ে বেশি বেকার হচ্ছে শিক্ষিত নারীরা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে। উৎপাদন ও কর্মসংস্থানসহ দারিদ্র্যের নিয়ামক সূচকগুলোর প্রতিটিই এমন একটি পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয় যে দারিদ্র্য বেড়েছে। এখন কতটা বেড়েছে তা নিয়ে হয়তো যুক্তিতর্ক থাকতে পারে। মূল কথা হচ্ছে দারিদ্র্যের নিম্নগামী যে প্রবণতা ছিল এটা এখন আর বিদ্যমান নেই। এখন দারিদ্র্য বাড়ছে। কাজেই দারিদ্র্য কমাতে হলে বৈষম্য দূর করতে হবে। বৈষম্য দূর করতে না পারলে প্রবৃদ্ধির সুফল সুবিধোভোগী বা ক্ষমতালোভী শ্রেণীই ভোগ করবে। দরিদ্র কিংবা স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী এর সুফল পাবে না। কাজেই বৈষম্য দূরীকরণকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সুযোগের বৈষম্য দূর করতে হবে। কাজেই এ ধরনের পরিবর্তন যদি না করা যায় তাহলে দারিদ্র্য বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়বে।
বর্তমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো কতটা লক্ষ্যভিত্তিক ও ফলপ্রসূ? এক্ষেত্রে কী কোনো ধরনের পুনর্গঠন বা সংস্কার দরকার?
উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে কার্যকর, দক্ষ ও ন্যায়সংগত সামাজিক নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা কার্যক্রম দারিদ্র্য ও অসমতা সরাসরি হ্রাস করতে পারে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসে অগ্রগতি সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনসংখ্যা এখনো বিদ্যমান, যারা বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে দারিদ্র্যের সংস্পর্শে থাকে। বাস্তবতা এটা দেখায় যে দরিদ্র ও নিকট-দরিদ্রগোষ্ঠী সব নেতিবাচক ঝুঁকি ও ধাক্কা মোকাবেলা করতে পারে না তাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি আবির্ভূত হয়েছে দরিদ্র ও নিকট-দরিদ্রদের সহায়তা করার জন্য, যাতে নেতিবাচক ঝুঁকি ও ধাক্কা তাদের কল্যাণ প্রভাবিত করতে না পারে।
বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষার আইনগত ভিত্তি দেশের সংবিধান দ্বারা প্রদান করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোয় সামাজিক সহায়তা বাংলাদেশের প্রধান সামাজিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপান্তর ও উন্নয়নের জন্য সামাজিক সহায়তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এটি জোর দিয়ে বলা যেতে পারে যে দেশে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা যাদের সামাজিক সুরক্ষা দরকার তাদেরকে সঠিক সুরক্ষা দিতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ এটি সমাজের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে না। সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রায় অচল অবস্থায় আছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় শতাধিক প্রোগ্রাম আছে। এসব প্রোগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি থেকে শুরু করে অর্থের অপচয় বিদ্যমান। অনেক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় একটি পরিবারকে মাসে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ সামান্য পরিমাণ টাকার তাদের জীবনযাত্রায় কোনো প্রভাব ফেলার ক্ষমতা কি আছে? টিসিবির মাধ্যমে খাদ্য সহায়তাও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো দরিদ্র বা স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না।
উপরন্তু এগুলো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। কাজেই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো এমনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব আনতে সক্ষম হয়। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এমনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি পুনর্বাসন কর্মসূচিগুলোয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে ও নিজের আয়-উপার্জন বৃদ্ধি করে স্বাবলম্বী হতে পারে। আবার যারা বয়োবৃদ্ধ বা সক্ষমতা নেই তাদের জন্য এমন কর্মসূচি নিতে হবে যাতে তারা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারেন। অর্থাৎ আমাদের সহায়তা কর্মসূচিগুলোকে ঢেলে সাজানো দরকার। কর্মসূচির লক্ষ্যগুলোকে এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে সর্বজনীন কল্যাণ নিশ্চিত হয় এবং দরিদ্ররা নির্ভরশীল না হয়ে স্বাবলম্বী হতে পারে।
দেশে কী ‘নতুন দারিদ্র্য’-এর ধারা তৈরি হচ্ছে—বিশেষত নগর শ্রমজীবী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মধ্যে?
সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্যের প্রকৃতি ও গতিশীলতা বেশ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজে যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, অর্থনীতিতেও পরিবর্তন হচ্ছে। আগে যে গতানুগতিক ধারা ছিল সেটি এখন বিদ্যমান নেই। এখন মানুষ দারিদ্র্য হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। এর মধ্যে রয়েছে কাঠামোগত বৈষম্য, সমাজের ক্ষমতাবান ও অভিজাতদের প্রতি রাষ্ট্রের নীতিগত পক্ষপাত, বিশ্বায়নের প্রভাব, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রতিকূল প্রভাব, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত দুর্যোগ এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত আরো অনেক কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিঘাত আমরা সরাসরি মোকাবেলা করছি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোর জন্য এমন আর্থিক কৌশল তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, যা দুর্যোগ মোকাবেলায় দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আমাদের এমন আর্থিক পণ্য এবং পরিষেবা ডিজাইন করতে হবে যা এই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকরভাবে সাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে, যা বাংলাদেশের তিনটি প্রভাবের পথকে অন্তর্ভুক্ত করবে: স্থিতিস্থাপকতা, অভিযোজন ও উত্তরণ। সমাজ ব্যবস্থা, কৃষি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে দারিদ্র্যে প্রভাব পড়ছে।
দারিদ্র্য সৃষ্টির নতুন কারণগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে আসন্ন দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারে সেই সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও জলবায়ু পরিবর্তন অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে যে পরিবর্তনগুলো এখন শুরু হয়েছে বা আগামী দিনগুলোয় পরিবর্তনগুলো যেভাবে আরো ঘনীভূত হবে, সেগুলো মাথায় রেখে দারিদ্র্য সৃষ্টির কারণগুলোকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে। নতুন করে কোনো মানুষ যাতে দারিদ্র্যে পতিত না হয় সেদিকে সহায়তা প্রদান করা দরকার। এ পরিবর্তনগুলো মাথায় রেখে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে আমরা টেসকই সমাধানের দিকে যেতে পারি।
আপনার দৃষ্টিতে আগামী দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী হবে—রাজস্ব, কর্মসংস্থান নাকি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা?
অন্যান্য অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও একটি আন্তঃসংযুক্ত কাঠামো রয়েছে যার মাধ্যমে সমাজের সব মানুষ চাহিদা পূরণের জন্য পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন, বিতরণ এবং ব্যবহার সংগঠিত করে। এতে রাষ্ট্র ও অর্থনীতির সব প্রতিষ্ঠান, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ও ভোগের ধরন অন্তর্ভুক্ত এবং এর কাঠামো বৃহত্তর সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। ফলস্বরূপ অর্থনীতির একটা ক্ষেত্রের সঙ্গে আরেকটার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। এজন্য রাজস্ব, কর্মসংস্থান ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এ তিন বিষয় আলাদা নয়, প্রতিটিই একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। সঠিকভাবে রাজস্ব আদায় না হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে পিছিয়ে পড়তে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
বেসরকারি খাতে সাত-আট বছর ধরে বিনিয়োগ ২৩-২৪ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, খুব একটা বাড়েনি। এখন বাড়ার সম্ভাবনা আরো কম। আবার সরকারি খাতেও বিনিয়োগ এখন কমে গেছে। কারণ সরকারকে এখন বেশি বেশি ঋণ গ্রহণ করে চলতে হচ্ছে। তাহলে রাজস্ব আদায় বেশি না করতে পারলে নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করা যাবে না, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও অর্জন করা যাবে না। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা যদি না থাকে তাহলে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে না, রাজস্ব আদায়ও বাড়বে না। কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জন না করলে আমরা কোনটাই অর্জন করতে পারব না। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমাদের দক্ষ নীতি গ্রহণ ও সুপরিকল্পিত কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য আমাদের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আমাদের উন্নয়ন বেসরকারি খাতভিত্তিক। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
কাজেই প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমভাবে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে যদি সফলতা অর্জন করা না যায়, তাহলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। বর্তমানে আমরা উন্নয়নের এমন একটি পর্যায়ে আছি, যেখানে আগামী দশকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বব্যাপী মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। অতীতের দুঃশাসনের কারণে বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা সম্ভবত সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে যেমন নজর দিতে হবে, তেমনি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে আমাদের কর্মসংস্থানেরও বৃদ্ধি ঘটবে। কাজেই এ তিন বিষয়কে একসঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শমুখী নীতি অনুসরণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংস্থাটির নীতি অনুসরণ দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য উপকারী হবে, নাকি এতে সামাজিক চাপ বাড়বে?
অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শমুখী নীতি অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাদের ঋণ সম্পর্কিত শর্তাবলির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা সব উন্নয়নশীল দেশের জন্য একই নীতি প্রয়োগ করে, যদিও প্রতিটি দেশ আলাদা এবং এক দেশে সফল নীতি অন্য দেশে সফলভাবে প্রয়োগ করা যায় না। আমাদের আর ভিয়েতনামের অর্থনীতি এক রকম নয়। কাজেই ভিয়েতনামের সফল নীতি আমাদের দেশেও একইভাবে কাজ করবে তা কিন্তু নয়।
এজন্য আইএমএফ থেকে ঋণগ্রহণের শর্তগুলো দেশের জন্য সবসময়ে সুফল বয়ে আনবে তা কিন্তু নয়। কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। কিন্তু রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির কৌশল আমাদের দেশের আলোকে নির্ধারণ করতে হবে। তাই আইএমএফের বিধিনিষেধ অনুসরণ না করে নিজের দেশের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেকের আলোকে এ কৌশলগুলো নির্ধারণ করতে হবে। মৌলিক বিষয় হচ্ছে, আইএমএফ যা চায় সেটি আমরাও চাই। যেমন শক্তিশালী ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান, কার্যকরী আর্থিক খাত, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ। দ্বিমতের জায়গাটি হচ্ছে কৌশলগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করলে তা সফল হবে, সেটি নির্ধারণ করা যা বিদেশী পরামর্শদাতাদের চেয়ে স্থানীয় নীতিনির্ধারকদের দ্বারা আরো ভালোভাবে ডিজাইন করা যেতে পারে।
নিঃসন্দেহে আমাদের উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে সহায়তা প্রয়োজন, কিন্তু বিদেশী ঋণ কৌশলগতভাবে গ্রহণ করতে হবে যাতে প্রতিশ্রুত সুবিধা অর্জিত হয় এবং এগুলো সামাজিক অস্থিরতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বোঝার উৎস হয়ে না ওঠে। বিশেষ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমানে প্রচলিত নব্য উদারবাদী কাঠামোর অধীনে অসম উন্নয়ন এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসমতার শক্তিশালী প্রবণতা সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষমতা ও সামর্থ্যের চরম অসম আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বণ্টনের অধীনে চলমান কাঠামোগত রূপান্তর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রকে ধনী ও ক্ষমতাবানদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হতে বাধ্য করে এবং রাষ্ট্রের ওপর ‘অভিজাত শ্রেণীর একচেটিয়া কর্তৃত্ব’ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ঘাটতিকে প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি অবদান রাখে। বিদেশী আর্থিক ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের সুচিন্তিত কৌশল অবলম্বন করতে হবে যাতে সব সম্পর্কিত নীতিগুলোর অনুসরণ দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য উপকারী হয়। সূত্র: বণিক বার্তা

