বৃহস্পতিবার রাতে আমি যখন লিখছি, ঠিক এ সময় এক দল উগ্রপন্থী দেশের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা অফিস প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার ভবনে হামলা করেছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এরপর তারা চলে গেছে দেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের দিকে।
ফেসবুকে একের পর এক ভিডিও ঘুরছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে সিনিয়র সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর হামলা হচ্ছে, অন্য ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ভাংচুর আর অগ্নিসংযোগ। ডেইলি স্টারের এক তরুণী সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, ধোঁয়ায় তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না, সাহায্য চাইছেন। ৩০ জনের বেশি সাংবাদিক ডেইলি স্টার ভবনের ছাদে আটকে ছিলেন, ঠিক সেই সময় নিচে আগুন লাগানো হয়। প্রশ্নটা খুব সোজা: টার্গেট কি কেবল ভবনটা, নাকি ভবনের ভেতরে থাকা মানুষগুলোও?
এটা এক ধরনের কৌশল। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর দোষ চাপিয়ে তারা আসলে লড়াইয়ের ময়দানটাই বদলে দিতে চাইছে। বার্তাটা পরিষ্কার: যারা তাদের স্লোগান, তাদের নায়ক, তাদের ইতিহাসের বয়ান পুরোপুরি মেনে নেবে না, সবাই শত্রু। এ যুক্তিতে একজন সাংবাদিক, কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পী বা বহুত্ববাদের পক্ষে কথা বলা কোনো শিক্ষককে হত্যাকারীর সমান জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। একবার যখন এ সীমা পেরোনো হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে সবই ন্যায্য হয়ে যায়: হয়রানি, সামাজিক বয়কট, এমনকি শারীরিক আক্রমণও। সব কিছুর গায়ে আবার সুন্দর শব্দ বসানো হয়: ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’, ‘শহীদের ন্যায়বিচার’, ‘দেশ পরিশুদ্ধ করা’। প্রতিশোধকে নৈতিকতার মোড়কে বেচা হয়।
আমরা যা দেখছি, তা শোককে পুরনো হিসাব মিটিয়ে ফেলার ফাঁকা চেকে পরিণত করার চেষ্টা। প্রকৃত হামলাকারীদের দিকে, আর একজন নাগরিককে রক্ষা করতে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ক্ষোভ ঘুরিয়ে দেয়ার বদলে এরা হাদির কষ্টকে ব্যবহার করছে তাদের অপছন্দের সব কণ্ঠকে চুপ করিয়ে দিতে। তারা নিরাপদ বা ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে চায় না, তারা চায় এমন একটা বাংলাদেশ, যেখানে জনপরিসরে কেবল এক ধরনের কণ্ঠ থাকবে। এটা কোনো বিপ্লব নয়; এটা পুরনো বাদ–দেয়া রাজনীতিরই নতুন পোশাক।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নতুন কিছু না। জুলাই-আগস্ট থেকে আমরা দেখেছি ছাত্র – ও সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় অভিযান হয়েছে। এতে আন্দোলনকারী, সাধারণ মানুষ, এমনকি পুলিশের সদস্যও মারা গেছেন। ৫ আগস্ট তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতন আর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর অনেকে ভেবেছিল, নতুন সরকার প্রথমে দেশকে স্থিতিশীল করবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তারপর নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
তার বদলে আমরা দেখছি ঘৃণার সংস্কৃতি আরো ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে মাজার-দরগাহে হামলা হয়েছে, মরদেহ কবর থেকে টেনে বের করে জনসম্মুখে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। সমাজের কট্টরপন্থী অংশ নিজেদের মূলধারা ভাবছে এখন এবং এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, যেখানে কোনো বহুত্ববাদ থাকবে না। সরকারের পক্ষ থেকেও অনেক সময় এদেরকে ‘প্রেশার গ্রুপ’ বলে নরম করে পরিচয় দেয়া হয়েছে, যা এ হুমকির প্রকৃত গুরুত্ব ঢেকে দেয়।
যারা সরকারের এ দুর্বলতার সমালোচনা করেছে, আবার একই সঙ্গে অন্তত দুটি বড় রাজনৈতিক শিবিরের জনতুষ্টিবাদী কথাবার্তার বিরুদ্ধেও কথা বলেছে, এখন তাদেরই ‘প্রো ফ্যাসিস্ট’ বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। এ লেবেল খুব সুবিধাজনক; এতে আসল সহিংসতা থেকে দৃষ্টি সরে গিয়ে সেই সব মানুষের দিকে চলে যায়, যারা কেবল প্রশ্ন করছে।
এ পরিবেশ কত ভয়াবহ তা আমরা এরই মধ্যে দেখে ফেলেছি। জুলাই আন্দোলনের সবচেয়ে পরিচিত মুখগুলোর একজন, ওসমান হাদি, দিনের আলোয় নির্মম হামলার শিকার হয়েছেন। সাংবাদিক ও ফ্যাক্টচেকাররা বারবার লিখেছেন, যিনি গুলি করেছেন, তিনি নাকি আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, সেই দলেরই সরকার বিদায় নিয়েছে এবং যার নেত্রী এখন প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। সময়ের ব্যবধানে এ অভিযোগগুলো আইনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচাই-বাছাই হবে।
হাদি ভয়ংকর কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছে। তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়েছে। অনেকেই চেয়েছেন অলৌকিক কিছু ঘটুক, যাতে সে ফিরে যেতে পারে তার ছোট সন্তানের কাছে, স্ত্রী ও মায়ের কাছে। সেই অলৌকিকতা ঘটেনি। হাদি এখন শহীদ, আর তার মৃত্যুকে ঘিরে নতুন করে প্রতিশোধের আগুন জ্বালানো হয়েছে। পরের দিনগুলোতে কিছু রাজনৈতিক নেতা, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী আর দলীয় কর্মী প্রকাশ্যেই প্রতিশোধের ভাষা ব্যবহার করেছেন। তারা অন্যদের ‘সাংস্কৃতিক ফ্যাসিস্ট’ বলেছে, ইঙ্গিত করেছে এ মানুষগুলোকে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরিয়ে ফেলতেই হবে।
রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া হয়েছে বেছে–বেছে, অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে। যারা প্রকাশ্যে সহিংসতার ডাক দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে, হাদির গুলিবর্ষণের ঘটনায় জড়িত নয় এমন একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে জনতুষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে ঘৃণার রাজনীতি চালানোদের কাছে বার্তাটা স্পষ্ট গিয়েছে: যা খুশি বলুন, যাকে খুশি টার্গেট করুন, আপনাদের কিছু হবে না।
আজ রাতের ঘটনাই সেই আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ। হাদির মৃত্যুর খবর প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এরা শত শত মানুষ জড়ো করে দেশের শীর্ষ দুই দৈনিক ও একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে। সরকার তাদের থামাতে পারেনি, অথবা চায়নি। শুধু গোয়েন্দা ব্যর্থতা বা পুলিশের ব্যর্থতা দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটা মূলত রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যর্থতা। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, সংগঠিত সন্ত্রাসের সামনে রাষ্ট্র তার নাগরিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে রক্ষা করতে অক্ষম।
বাংলাদেশ যদি সত্যিই গণতন্ত্রের পথে ফিরতে চায়, তাহলে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই। যদি এ আন্দোলনকারীরা, তাদের সশস্ত্র অনুগামীরা এবং তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকরা নির্বাচন ঠেকাতে বা দীর্ঘসূত্রতায় ফেলতে সফল হয়, তাহলে দেশ এমন এক বিশৃঙ্খলার দিকে যাবে, যার পরিণতি কল্পনা করাও কঠিন। যেখানে কে লিখবে, কে গান গাইবে, কে প্রকাশ করবে, সবকিছু মব ঠিক করে দেবে, সেই রাষ্ট্র বেশি দিন প্রজাতন্ত্র হয়ে থাকতে পারে না।
তাই এখন দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, তাদেরও, যারা এখনো বহুত্ববাদী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। মানুষকে দাঁড়াতে হবে, স্পষ্ট ভাষায় বলতে হবে যে আমরা বৈচিত্র্য চাই, ভিন্নমত চাই; আমরা পত্রিকার স্বাধীনতা, সাংবাদিক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা চাই। সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব হচ্ছে তদন্ত করা, ভিডিওতে যাদের মুখ দেখা যাচ্ছে তাদের শনাক্ত করা, আদালতের মুখোমুখি করা।
যদি সরকার এটুকুও না করে তাহলে রাতের আগুনই বলে দেবে—যা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা পাওয়ার কথা ছিল, সেটাই তারা রক্ষা করতে পারেনি।
- আসিফ বিন আলী: ডক্টরাল ফেলো, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র। সূত্র: বণিক বার্তা

