এ বছর ডিসেম্বর এসেছিল অপেক্ষাকৃত উষ্ণতা নিয়ে। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ–দলীয় বয়ান থেকে মুক্তিযুদ্ধকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাও তরুণদের একটা অংশের মধ্যে দেখা গেল এই ডিসেম্বরেই। নাগরিকদের জন্য একটা আশাবাদের বার্তা নিয়ে আসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা।
সবাই আশা করেছিল, তফসিল ঘোষণার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হবে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল, নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতে এক লাখের বেশি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ ৯ লাখের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবেন।
কিন্তু তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিন (১২ ডিসেম্বর) ঢাকার বিজয়নগরে বক্স কালভার্ট রোডে মোটরসাইকেলে আসা সন্ত্রাসীরা টার্গেট করে খুব কাছ থেকে মাথায় গুলি করল ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে। সাত দিন জীবন–মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ ওসমান হাদির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে খুব স্বাভাবিকভাবেই শোক ও ক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। হাদিকে গুলি করার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘাতকদের ছবি, নাম, পরিচয় প্রকাশিত হয়। কিন্তু ওসমান হাদিকে গুলি করা প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান ওরফে রাহুল ও তাঁর সহযোগী মোটরসাইকেলচালক আলমগীর শেখকে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের এই দুই নেতা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। তাঁদের গ্রেপ্তার না হওয়া ও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা জনমনে ক্ষোভ ও হতাশা অনেক গুণ বেড়ে যায়। নানা উগ্রবাদী গোষ্ঠী সেই ক্ষোভকে অনলাইন ও অফলাইন ব্যবহার করে ভিন্নদিকে উসকে দিতে থাকে। তারা প্রকাশ্যে গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সহিংসতার উসকানি দেয়। ১৮ ডিসেম্বর রাতে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার কার্যালয় আক্রান্ত হয়। পুরো ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে তাদের ভূমিকা কী ছিল, সেটা সবাই দেখেছে।
রাজধানী ঢাকার বুকেই যদি শীর্ষ সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত হয় এবং কর্মস্থলেই সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকতে হয়, তাহলে বাকি দেশের অবস্থা যে কী, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম সবখানে মানুষের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের নাম হলো নিরাপত্তা।

হাসিনার আমলে আমরা দেখেছি, একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্র ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে কীভাবে নাগরিকদের ওপর চেপে বসতে পারে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রাজনৈতিক ব্যবহারে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিরোধীদের দমন, মামলা, হামলা, ডিজিটাল নজরদারির মধ্য দিয়ে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করাটাই ছিল হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে থাকার মূল ভিত্তি। সেই শাসনে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার উৎসটা ছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনী, সামরিক–বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আর ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ক্যাডাররা।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নাগরিকের ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার মূল উৎস বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মব সহিংসতা। অনলাইন, অফলাইনে যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিতে পারছে। কারও মত, চিন্তা, চেহারা, পোশাক পছন্দ হচ্ছে না, কারও সঙ্গে চাকরিতে রেষারেষি—মব উসকে দাও। ফ্যাসিবাদের দোসর, ভারতপন্থী, বাউল—যেকোনো একটা তকমা লাগিয়ে দাও। ব্যস…।
গত ১৬ মাসে দেশে একের পর এক মাজার, দরগাহ শরিফে হামলা হয়েছে; ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। বাউলেরা আক্রান্ত হয়েছেন। এমনকি কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পথে–ঘাটে, জনপরিসরে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীরা আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের পরিসর সংকুচিত হয়েছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরাও আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু বিবৃতি দেওয়া আর দু–একজনকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা, বাক্স্বাধীনতা ও ধর্মচর্চার স্বাধীনতা রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে এই বার্তাই গেছে, তারা এতটাই ক্ষমতায়িত যে দায়মুক্তি নিয়েই যা খুশি তা–ই করতে পারে। এই বার্তা যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাক কারখানার শ্রমিক দীপু দাসের হত্যাকাণ্ড তারই দৃষ্টান্ত।
পরিবারের একমাত্র রোজগেরে দীপুকে হত্যার রাতটি ছিল ১৮ ডিসেম্বর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, একদল উন্মত্ত লোক তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে তাঁর বিবস্ত্র লাশটি গাছে ঝুলিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। দীপুর স্ত্রী, বাবা ও পরিবারের স্বজনদের আহাজারি ও প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? একটা দেড় বছরের শিশুকন্যা আছে দীপুর। সেই শিশুটির ভবিষ্যৎ এখন কী হবে।
পুলিশ ও র্যাব এ ঘটনায় ১০ জনকে আটক করেছে। র্যাব জানিয়েছে, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দীপুকে হত্যা করা হয়েছে, সেই অভিযোগের বিষয়টি অস্পষ্ট। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে এমন খবর এসেছে, তাঁর সহকর্মীদের কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধে মব সহিংসতা উসকে দিয়েছেন। স্বজনদের প্রশ্ন, দীপুর যদি সত্যিই কোনো অপরাধ থেকে থাকত, তাহলে তাঁকে আইনের মাধ্যমে বিচার করত। কেন তাঁকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো?
শুক্রবার গভীর রাতে লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে বিএনপির একজন স্থানীয় নেতার ঘরে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ঘরের বেড়া কেটে বড় দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বের হতে পারলেও, সাত বছরের শিশু আয়েশা আক্তার পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। কী অপরাধ ছিল এই শিশুটির? মা ও বাবার চোখের সামনে পুড়ে মারা যায় আয়েশা। বাঁচার জন্য চিৎকার করলেও বাঁচানো যায়নি। এর থেকে বড় ট্র্যাজেডি, অসহায়ত্ব মানুষের আর কি হতে পারে!
রাষ্ট্র–সরকার যখন ভুলে যায় এবং উপেক্ষা করে— যে দল, মত, পথ, বিশ্বাসের হোক না কেন নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাই তার দায় ও দায়িত্ব, তখন নিরাপত্তাহীনতাই নাগরিকের একমাত্র নিয়তি হয়ে যায়। আমি, আপনি, আমরা কেউই এখানে নিরাপদ নই।
দীপু, আয়েশা আক্তার—সবাই রাষ্ট্রের দায় ও দায়িত্বহীনতার একেকজন শিকার। এই মৃত্যু তো থামাতেই হবে। কিন্তু থামাবে কে? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গের অবিস্মরণীয় কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ অবলম্বনে মৌসুমী ভৌমিকের গান থেকে ধার নিয়ে প্রশ্ন করি, ‘কাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাও/ মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রাণ।’
- মনোজ দে: প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও উগ্রবাদী মব সহিংসতায় নাগরিক নিরাপত্তা ভয়াবহভাবে সংকুচিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তায় সাংবাদিক, সংখ্যালঘু, নারী ও সাধারণ মানুষ ক্রমবর্ধমান সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এই ধারাবাহিক মৃত্যু ও নিরাপত্তাহীনতা রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার করুণ চিত্র তুলে ধরেছে। সূত্র: প্রথম আলো

