জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে জুলাই সনদের ওপর গণভোট অনুষ্ঠানের বেশ তোড়জোড় চলছে। বিএনপি এ নিয়ে এখনও কিছু না বললেও জামায়াতে ইসলামী এবং তার মিত্ররা গণভোটে হ্যাঁ ভোটের পক্ষে প্রচার শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারও আনুষ্ঠানিকভাবে একই প্রচার শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
কিন্তু স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের সঙ্গে যে সনদ নিয়ে গণভোট হচ্ছে, তার বিপুল পার্থক্য আছে বলে বিএনপির অভিযোগ। গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং বাংলাদেশের ২৫টি রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে এতে স্বাক্ষর করে। সংবিধানের চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে এবং আরও কিছু বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে কয়েকটি বাম দল এতে স্বাক্ষর করেনি। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ গেজেটরূপে জারি হয় গত ১৩ নভেম্বর। এতে গণভোটে জনগণের সম্মতির জন্য যে চারটি বিষয় প্রশ্ন আকারে রাখা হয়েছে, সেগুলো ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে ভিন্নমতের যে স্বীকৃতি ছিল, তাকে নাকচ করে দিয়েছে। ফলে গণভোটে সম্মতি পেলেও জুলাই সনদ নিয়ে বিতর্ক থামবে না– তা বলা যায়।
এমনও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সংবিধান থেকে স্বৈরতন্ত্রের বীজ উপড়ানো এই সনদ তৈরির মূল লক্ষ্য বলা হলেও- জুলাই সনদ স্বৈরতন্ত্রের একটা নতুন রূপ তৈরি করবে। বিদ্যমান আর্থসামাজিক কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে কিছু অধিকাঠামোগত রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্যে আটকে দেওয়া হয়েছে পরিবর্তনকে। এই সনদে স্বৈরতন্ত্রকে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আর আওয়ামী লীগের দলগত সমস্যা হিসেবে দেখা হয়েছে। বাংলাদেশের শোষিত ও প্রান্তিক মানুষের বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত বল প্রয়োগ করে টিকে আছে, আগামীতেও থাকতে চাইবে। এর অনুমতিই জুলাই সনদে দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তিসংগত বিতর্ক আছে। তা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে কতগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই সংবিধানে এসব মৌলিক অধিকারকে অলঙ্ঘনীয় ও অবিভাজ্য অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। যে কারণে এই তৃতীয় ভাগের প্রথম অনুচ্ছেদ তথা ২৬.১-এ বলা আছে, ‘এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’
২৬.২-এ বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’ অর্থাৎ এই ২৬ (১) ও ২৬ (২) অনুচ্ছেদ ছিল মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ। আর সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কিত মৌলিক অধিকারে বলা ছিল:
৩৩। (১) গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।
(২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।
(৩) এই অনুচ্ছেদের (১) ও (২) দফার কোন কিছুই সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না, যিনি বর্তমান সময়ের জন্য বিদেশি শত্রু।
কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের পরপরই স্বৈরতন্ত্রের পথে পা বাড়ায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। অন্যদিকে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও নির্যাতন চালাবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের বিধানাবলি। সে কারণে সংবিধানের ওপর প্রথম আক্রমণ হানা হয় ১৯৭৩ সালের দ্বিতীয় সংশোধনীতে। সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে উপ-অনুচ্ছেদ ২৬ (৩) যুক্ত করে বলা হলো, ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত সংশোধনের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না।’
অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ২৬ (১) ও ২৬ (২)-তে মৌলিক অধিকার সুরক্ষার যে গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল, তার প্রাচীর উপড়ে ফেলা হলো। ওই একই দ্বিতীয় সংশোধনীতে গ্রেপ্তার ও আটকের শিকার ব্যক্তির জন্য রক্ষাকবচ ৩৩ অনুচ্ছেদে বিপরীত ধারা যুক্ত করে বলা হলো–
(খ) যাঁহাকে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোন আইনের অধীন গ্রেপ্তার করা হইয়াছে বা আটক করা হইয়াছে।
অর্থাৎ এই নিবর্তনমূলক আইনে কাউকে আটক করা হলে অনুচ্ছেদ ৩৩ (১) ও (২)-তে বর্ণিত মৌলিক অধিকার তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। সংবিধানের এই সংশোধনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। এই বিশেষ ক্ষমতা আইন দিয়ে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই কাউকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক করা যায়। এটাই স্বৈরতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তি, যা দিয়ে ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকার হরণ করা যায়।
বিশেষ ক্ষমতা আইন ’৭৪ দিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এরশাদ, এমনকি বর্তমান ড. ইউনূস সরকার পর্যন্ত মানুষকে বিনা বিচারে আটকে রাখছে। অতীতে নির্যাতিত হয়েও ক্ষমতায় গিয়ে কোনো দলই এ আইন বাতিল করেনি। এবারেও একই কাহিনি। ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদ নিয়ে অনেক বুলি কপচালেও তা পরিবর্তনের জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কিছুই বলেনি।
সংবিধানে মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার বিধান অক্ষুণ্ন রেখে স্বৈরতন্ত্র ঠেকানো হবে কীভাবে? বলা যায়, জুলাই সনদ স্বৈরতন্ত্রের আঁতুড়ঘরেই হাত দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
- ড. আখতার সোবহান মাসরুর: লেখক ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্রনেতা। সূত্র: সমকাল

